Jalpai: খাদ্যগুণে ভরপুর লাভজনক ফল জলপাই চাষে পরামর্শ দিলেন ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তী

Share with Friends

গরম পড়ছে, মার্চের শেষ দিন। নদীয়া-উত্তর ২৪ পরগণা লাগোয়া একটি স্থান। সেখানে দেখছি জলপাইয়ের গাছ ভরে ফুলের মুকুল। তিন দিন আগেই তা খেয়াল করেছিলাম– গাছের গোটা কাণ্ড জুড়ে বেরোচ্ছে অসংখ্য ছোট্ট সবুজ শুঁড়ের মতো পুষ্প-মুকুল, একেবারেই প্রাথমিক দশা। তখন ছবি তোলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। এদিন ছবি তুললে পরিস্কার বোঝা গেল, এ জলপাইয়ের মুকুল। ফুলল ফুটতে এখনও দেরি।

সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকটি মনে পড়ে গেল। সেখানে গ্রীষ্মের এক তপ্ত দিনে পথিক ও ঝুড়িওয়ালার মধ্যে ‘জলপাই’ বচসা চলছে–

পথিক: মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?

ঝুড়িওয়ালা: জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ ত জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম নিতে চান দিতে পারি‒

পথিক: না না, আমি তা বলিনি‒

ঝুড়িওয়ালা: না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা ত আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম‒

পথিক: না হে আমি জলপাই চাচ্ছিনে‒

ঝুড়িওয়ালা: চাচ্ছেন না ত ‘কোথায় পাব’ ‘কোথায় পাব’ কচ্ছেন কেন? খামকা এরকম করবার মানে কি?

পথিক: আপনি ভুল বুঝেছেন‒ আমি জল চাচ্ছিলাম‒ঝুড়িওয়ালা: জল চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয়‒ ‘জলপাই’ বলবার দরকার কি? জল আর জলপাই কি এক হল? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা মাছরাঙাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন?

পথিক: ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে।

চৈত্রের এই গরমের বাতাবরণে জলপাইয়ের ফুলের কথা তুলে পাছে বেকুব বনে যাই! তাই আগে ভাগে ‘মাপ’ চেয়ে নিচ্ছি নাটুকে ‘ঝুড়িওয়ালা’-র কাছে! আম-মরশুমে ‘জলপাই-দোষ’ তিনি যেন নিজ গুণে মাফ করে দেন!

গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ফেব্রুয়ারি মার্চে গাছে এসেছিল জলপাইয়ের লালচে কচি পাতা। শীতের সময় পুরোনো পাতাগুলি লাল হয়ে ঝরে পড়ে। বলা যায়, গাঙ্গেয় পলিঘটিত দক্ষিণবঙ্গে এপ্রিল থেকে অক্টোবর সময়কালটা হচ্ছে জলপাইয়ের ফুল-ফলের দশা মুকুল বেরোনো থেকে শুরু হয়ে পুষ্ট ফল তোলার মধ্যেকার সময়কাল, সব মিলিয়ে প্রায় সাত মাস। জাত ভেদে একটু আগে-পরে হতে পারে। উত্তরবঙ্গে একটু আগেই চয়ন করা যায় জলপাইয়ের ফল।

উত্তরবঙ্গের একটি জেলার নাম জলপাইগুড়ি। ‘জলপাই’ শব্দটি  এখানে এসেছে ‘জল্পেশ্বর’ শিব কথাটি থেকে। জলপাই-ও একটি ভারতীয় উপমহাদেশের ফল, একটি ক্রান্তীয় ফল। ভারতে যে সমস্ত ফুল-ফল শিব-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, তার অন্যতম ‘জলপাই’। এছাড়া অন্য ফুল-ফলগুলি হল– বেল, কদবেল, হরবরই (রয়্যাল), হরিতকী, নোনা, ধুতুরা, আকন্দ, ভাঁট, নীলকণ্ঠ ইত্যাদি। ‘জল্পেশ’ শব্দটি থেকে ‘জলপাই’ কথাটি এসেছে বলে লোক-বিশ্বাস৷ 

জলপাইয়ের বিজ্ঞানসম্মত নাম Elaeocarpus serratus , ইংরেজি নাম Ceylone Olive অর্থাৎ ‘শ্রীলঙ্কার অলিভ’ হিসাবে এটাকে গণ্য করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় শিব-সংস্কৃতি খুব প্রাচীন। এদিকে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে শরৎকালে ভাদ্র সংক্রান্তির ব্রত, আশ্বিনের নল সংক্রান্তির পার্বণ, দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজার সময় জলপাই ফল দিয়ে সুন্দর চাটনি তৈরি করে ভোগ দেওয়া হয় দেবতাকে।

এর পুষ্ট ফলের ওজন আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ গ্রাম, ফলের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে চার সেন্টিমিটার, ব্যাস আনুমানিক পৌনে তিন সেন্টিমিটার। পাকা ফলে একটি বিশেষ সবুজ রঙ আছে, যাকে বলা হয় ‘জলপাই সবুজ’। এতে বেশ লম্বাটে শক্তপোক্ত বীজ হয়। খোসা আর বীজের মাঝে টকমিষ্টি স্বাদের মনোরম শাঁস।

এই শাঁস দিয়ে তৈরি আচার খেতে বেশ লাগে। এজন্য ফলটি সামান্য গরম জলে ফুটিয়ে নিতে হবে। বীজ আর খোসা সরিয়ে, তার শাঁস সামান্য তেলে মশলা সহযোগে নেড়েচেড়ে তারপর নুন, চিনি মিশিয়ে আবারও ফোটানো হয়। সামান্য সাইট্রিক অ্যাসিড মেশালে তা সংরক্ষকের কাজ করে। আচার একটু বাদামি রঙ হলে, আগুন থেকে তুলে নিয়ে পরে রাখা হয় কাঁচের বয়মে। মাঝেমধ্যে রোদে দিতে হয় শিশি। অনেকদিন ভালো থাকে।

জলপাই বীজের তেল খুবই মহার্ঘ। এই তেল ভোজ্য। তা খেলে দেহে চর্বি জমার সমস্যা তো হয়ই না, উপরন্তু দেহের ফ্যাট সরাতেও কাজে দেয় বলে জানা গেছে। জলপাইয়ের ফলে থাকে ভাল মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার দূরে রাখতে সাহায্য করে। এই ফল নিয়মিত ভোজনে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকে না।

একটি দশ বছর বয়সী জলপাই গাছ থেকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ কেজি মতো ফল পাওয়া যায়। বড়সড় টবে রক্ষিত চার-পাঁচ বছরের কলমের গাছ থেকে বছরে ৪ থেকে ৫ কিলো জলপাই হতে দেখা গেছে।

জলপাই গাছের চারা তৈরি করতে হয় বর্ষাকালে। অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে চারা হয়। এজন্য পেনসিল মোটা বিটপে গুটিকলম বাঁধতে হবে। বর্ষাকালে চারা তৈরির সময় শেকড় গজানোর জন্য হর্মোন ব্যবহার না করলেও চলে। খুব সহজ এই চারা তৈরি। কিছুটা জৈবসার মিশ্রিত ভেজা মাটি, পলিথিনের রুমাল, কিছুটা পাটের সরু দড়ি লাগবে।

যে জায়গায় শেকড় গজাতে হবে, তা পর্বের তলার অংশ থেকে দুই-তিন সেন্টিমিটার মতো ছাল তুলে নিন ‘বাডিং-কাম-গ্র্যাফ্টিং নাইফ’ বা ছুরি দিয়ে। ছাল তোলার পর পিচ্ছিল হড়হড়ে ক্যাম্বিয়াম অংশ ছুরি দিয়ে চেঁচে তুলে দিন। এরপর মাটির লেচি তার উপর মাকুর মতো করে স্থাপন করে পলিথিন শীট দিয়ে ভালভাবে তা জড়িয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিন।

একমাস পরে তাতে পর্যাপ্ত শিকড় গজালে সিকেটিয়ার দিয়ে মা-গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেই তৈরি হবে নতুন চারা। পলিথিন খুলে যত্ন করে তা টবে বা পলিব্যাগে মাট-সারের মিশ্রণ ব্যবহার করে বসিয়ে সেচ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তারপর শিকড় ঠিকঠাক এলে ইচ্ছেমতো জায়গায় যত্ন করে বসান।

আসুন, আপনিও টবে দুই একটি গুটি কলমে তৈরি চারা লাগান। আবাস সন্নিহিত জমি থাকলে একটি গাছ লাগালে তার অসাধারণ সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবেন। বেশ সুন্দর এই গাছের তেল চকচকে পাতা, ঘন ঠাস বুনোটের ডালপালা-বিটপ, কচি ও পরিণত পাতার লালচে রঙে মন ভরে যাবে। সঙ্গে তার ফুলের সৌন্দর্য আর ফলের জলপাই রঙ উপভোগ করুন।


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *