Sage leaved Alangium: শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে দেয় আঁকল কাঁটা ফুল: ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তী

Share with Friends

ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তী

পল্লীবাংলার শিশু-কিশোরের চোখ জুড়োনোর জন্যই বোধহয় বুনোফুল ফোটে। তাদের মন বুঝি আলাদা হয়! চোখও দেখে তেমনই! ঝোপঝাড়ের বনপুলক তাকে ডাক দেয়। ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় তার মিষ্টি গন্ধ। বুনোফুল তাদের পরিতৃপ্তির জন্যই ফোটে। প্রকৃতির খেলাঘরে বনের অ-গরল ফল মুখে নিয়ে তার পরিতৃপ্তি। এই অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারাই চিনতে পারবেন আঁকর কাঁটা সুগন্ধি ফুল।

আহা, সেই গন্ধ-অণুর আইসোমার দিয়ে বডি-স্প্রে যদি আজ হতো! কত চৈতালী বিকেলে অপরাহ্ন-ক্রীড়ার পর এই ফুলের পাপড়ি ভেজা জলে স্নান করে নির্মল সুগন্ধি হয়েছি তখন। ভাবতাম, এ কী পাগলামি! আজ ভাবি, নিত্যকালের মধ্যে এ মহাস্নান আর ফিরে আসবে না কোনোদিন। রহড়ার সে সব চেনা গাছপালা, বনবাদাড় ঘুরে বেড়ানো দিনগুলি এখন রোমন্থনের পাতায় চলে আসছে।

মনোভূমির জঙ্গল-মহলে, প্রত্ন-ইতিহাসে আজকের আলোচনা ‘আইহা গোটা’ বা ‘আঁকড় কাঁটা’ ফুল এবং তার ফল। এর ফল জৈষ্ঠ্যমাসে লালচে কালো অথবা মেরুন-রঙা হয়ে পাকতো। বুনো আঁশটে গন্ধ আছে পাকা ফলে। ছোটোবেলায় একে ‘আঁশটেফল’ বলতাম। মিষ্টিই খেতে, অল্প শাঁস, সাদা তার রঙ। পাকা ফলের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গিয়ে টেবিলের শূণ্য দোয়াতে এক ছড়া ছিঁড়ে সাজিয়ে রেখে দিতাম।

আঁকড় কাঁটাফল। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি।

পালপার্বণে সাজি নিয়ে বুনো ফুল কুড়োতে যাওয়া ছিল পাড়ার তিনবন্ধুর শখ। শিবরাত্রির সময় তুলতে যেতাম আকন্দ, শ্বেত আকন্দ, ধুতুরা, বেলপাতা, নীলকন্ঠ। ভাঁটফুল সবে ফুটতে শুরু করেছে। মুণ্ডিতমস্তক আঁকড় কাঁটার পত্রহীন ডালে উঁকি দিয়ে দেখি এসেছে তার সবুজ মুকুল। তারই কয়েকটিতে সাদা পাপড়ি বেরিয়ে এসেছে, বেরিয়েছে সাদা পুংকেশরচক্র, সোজা রেখার মতো তার গর্ভকেশর। বন্ধুরা এক বৃদ্ধ পুরোহিতের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে নিয়েছিলাম, আমাদের মন-জিনিস কয়েকটি ফুলও যেন শিবের পূজার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। তারমধ্যে আঁকর কাঁটা অন্যতম।

এক হিন্দিভাষী জনমজুর এই গাছটির নাম বলেছিলেন ‘আঁকল’। হ্যাঁ ‘আঁকোলাম’ নামেই পরিচিত এই ফুল কেরালায়। ‘আঁকোলা’ নামে কর্ণাটকের মানুষ গাছটিকে চেনেন। এর ইংরেজি নাম Sage leaved Alangium, বিজ্ঞানসম্মত নাম Alangium salviifolium . এটি কর্ণেসী (Cornaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি ঘন, ঝোপাকৃতি অনুচ্চ-বৃক্ষ, ক্ষুদ্র এর গুঁড়ি।

আগে পথের ধারে অহরহ হয়ে থাকতো। বীজ থেকে জন্ম নেওয়া অঢেল গাছ। শুকনো জমিতে, নদীর পাড়ে, অনুচ্চ পাহাড় মালভূমিতে এই গাছ স্বাভাবিক উদ্ভিদ ছিল। এখনও গাঁ-গঞ্জে এই গাছ পাওয়া যায়। কোথাও এই গাছ দিয়ে তৈরি হয় গৃহের বেড়া।

মিষ্টি গন্ধের এই ফুল, ফোটে ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসে, ফল পাকে মে-জুন নাগাদ। যখন ফুল ফোটে তখন গাছে কোনো পাতা দেখতে পাওয়া যায় না। ফল ধরতে ধরতেই বসন্তের ডাকে পাতা মেলে যায় গাছে। যখন সবুজ মার্বেলের মতো ফল কালো রঙে রূপান্তরিত হতে থাকে, তখন গাছে সুন্দর সবুজ পাতা। তখন কে বলবে, এ গাছই সেই গাছ!

এ গাছে ফুল ফুটলে অনেক প্রজাপতি আসে। আর আসে ছোটো-ছোটো পাখি; মধু আর মকরন্দের লোভে মৌটুসী। এই ফুলের দিকে তাকিয়ে আমি খড়দহে প্রথম চিনলাম মৌটুসীকে (Purple rumped Sunbird)। আসে টুনটুনি, মেটে-ঠোঁট ফুলঝুরি (Pale-billed flowerpecker)।

ফল পাকলে গাছে গাছে কোকিল, ছিট্ কোকিল, বুলবুলি, শালিখ, গো-শালিখ আর টিয়া। গাছে গাছে শাখামৃগ। শাখামৃগের মতোই আমরা ছেলের দল। নগরে এই ফুলের, এই ফলের ভাগ যদি সত্যিই চান, তবে শহরের মাঝে কিছু বুনো হারিয়ে যাওয়া এমন গাছের উদ্যান গড়ে তুলুন। অন্তত বেড়া-গাছ বা হেজ-প্ল্যান্ট হিসাবে।


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *