Goechala Trek: দুর্গম পথে স্বপ্নের অভিযান গোচালা, দীপিকার ডায়েরি থেকে

Share with Friends

দীপিকা রায়।

আপনার মতো আমাকেও এক ঘেয়েমি জীবন প্রায়ই উদাসীন করে দেয়। বারবার প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে… কী করছি আমি জীবনে? তার পরই উপলব্ধি করি প্রকৃতির মাঝেই আমার জীবনের সব রসদ। জীবন মানে আমার কাছে, মনের অপরিসীম পরিব্যক্তি, ঘন সবুজে হারিয়ে যাওয়া, পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখা, মেঘেদের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া, কখনও বা অন্ধকার জনশূন্য সমুদ্র তটে বসে আকাশের তারা গোনা। না কল্পনা নয়… এভাবেই অনুভব করেছি বার বার।   

পাহাড়-সমুদ্রের সেই চিরন্তন দড়ি টানাটানিতে আমি পাহাড়ের দলে। শুধু মনের ক্লান্তি নয়, শরীরের ক্লান্তিকেও এক নিমেশে ভুলিয়ে দিতে পারে পাহাড়। যদিও আর ৫ জনের মতো নয়, তবে ঠিক পঞ্চম ব্যক্তিটি হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একজন সাধারণ পর্যটকদের সুবিধা নিয়ে নয়, পায়ে হেঁটে অদেখাকে দেখব, অজানাকে জানব।

তাই ২০২০ সাল থেকেই একটু একটু করে ট্রেকিং পরিকল্পনায় নিজেকে যুক্ত করতে শুরু করলাম। বিশে বিষময়… করোনা আর লকডাউনের রেস নিয়েই কেটে গেল বছরটা। আমি কেবল পরিকল্পনাতেই আটকে রইলাম। পরের বছর ২১-এর হাত ধরে নতুন করে শুরু সব কিছু।

বছর শুরুতেই ঠিক হল মে মাসে ট্রেক হবে, গঙ্গোত্রী-গোমুখ-তপবন। শীত-পোশাক, ট্রেকের পোশাক, ট্রেকিং শু সব কেনাকাটা শেষ। ফ্লাইটের টিকিটও বুকড। ট্রেক এজেন্সিকে অ্যাডভান্স পেমেন্টও ডান। কিন্তু আমাদের সব স্বপ্ন চুরমার করে দিতে যেন ফের আছড়ে পড়ল করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। আবার সব মন খারাপের পালা।

শুধুই হতাশা… পরিকল্পনা সারা হলেও, স্বপ্নপূরণে বাধ সাধেছে করোনা। বার বার আমার মন যে আমাকেই বলছিল নিঃশব্দে চিৎকার করে, এই বস্তা পচা জীবন থেকে মুক্তি চাই… মুক্তি দে…এক মুঠো মুক্ত বাতাস দে। বলছিল পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা ভাসা ভাসা মেঘ আর জঙ্গলি জীবন-যাপনে নিয়ে চল আমাকে…। বড্ড মন টানছিল। করোনার বিধি নিষেধ কিছুটা কমতেই ঠিক হল অক্টোবরে বেরিয়ে পড়বই।

ট্রেক তো হবে, কিন্তু কোথায়? তালিকায় দু’টি নাম চূড়ান্ত হল, গোচালা পাস আর পিন-ভাবা পাস। অনেক চিন্তা-ভাবনা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হল ট্রেক যদি করতেই হয় তবে করব গোচালা পাস। সেই মতো একটা রুট প্যান এবং এস্টিমেট করা হল। জিনিসপত্র আগে কিছু কেনা ছিল। বাকি যা কেনাকাটা, প্রস্তুতি সব সেরে ফেললাম। আগের বার বিমানের টিকিট কেটে খুব ভুগেছিলাম, সব টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। তাই এবার আর আকাশ পথ না ধরে রেল পথই বেছে নিলাম। আর্থিক দিক থেকে ঝুঁকি এবং চাপ দুইই কম।

প্রতি অভিযানের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জীবনে যেমনটা হয় আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হল। প্রথমে ৮ জনের গ্রুপ তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে কমে চূড়ান্ত সম্মতি দিল ৫ জন। পাকাপাকি সিদ্ধান্ত হল, ২০২১-র দশমীর দিন বেরিয়ে পড়ব। গন্তব্য স্বপ্নের গোচালা পাস। স্বপ্ন সত্যি করার পালা।

আমার প্রথম অফিসিয়ালি ট্রেকিং। কারণ এর আগে একটু আধটু পাহাড়ে চড়ার চেষ্টা করলেও তাকে ঠিক ট্রেকিং বলা যায় না। এবার পশ্চিম সিকিমে অবস্থিত হিমালয় সারির অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেক রুট গো-চালা পাস। উচ্চতা ১৫ হাজার ১০০ ফুট। ইন্ডিয়া হাইক বলছে difficulty level: Difficult. আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কে জানত স্বপ্নের অভিযানে শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা এমন হবে!

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন।

শিয়ালদা থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। তার পর সেখান থেকে স্থানয়ী একটি এজেন্সির সঙ্গে ট্রেকিং করে ফের এনজেপিতে ফেরা। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই হল মোটামুটি এই আমাদের পরিকল্পনা। এই এনজিপি টু এনজিপি আমাদের মাথা পিছু খরচ পড়েছিল ১৭ হাজার টাকা। ওরাই গাড়ি থেকে শুরু করে গাইড, পোটার, টেন্ট যাবতীয় ব্যবস্থার দায়িত্বে। ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭ টা ৪০-এ শিয়ালহ থেকে আমাদের ট্রেন। শেষ মুহূর্তে টিকিট কনফার্ম না হওয়ায় তৎকাল কাটতে হয়েছিল… শিয়ালদহ-বামনহাট স্পেশাল।

স্বপ্নের ট্রেকিং, অভিযান শুরু। কিন্তু শুরুতেই অশনি সংকেত যেন। বাড়ির বাইরে পা রাখাতেই সে দিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। বৃষ্টি বাঁচিয়ে ব্যাগপত্র সামলে কোনও মতে শিয়ালদহ পৌঁছলাম। শেষ পর্যন্ত আমি এবং গ্রুপের বাকি ৪ সদস্য বিশ্বদা, অরিজিৎদা, সুব্রত আর অমিতদা।

সবাই মিলে ট্রেনে উঠে ব্যাগপত্তর গোছগাছ করে ডিনারটা সেরে নিলাম। এবার কিছুটা যেন নিশ্চিন্ত লাগছে। কিন্তু একই সঙ্গে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। ভিতরে ভিতরে রীতিমতো ফুটছিলাম। বিশ্বজিৎ দা বার বার জিজ্ঞেস করছিল, ‘কি রে টেনশন হচ্ছে নাকি? আরে আমরা আছি তো সব ঠিক হবে। কিছু চিন্তা করিস না’। টেনশন হচ্ছিল বৈকি… কিন্তু চাল-চলন, কথাবার্তায় সাহসী ভাবমূর্তি বজায় রাখলাম।

রাত গড়াতেই যে যার সিট বুঝে শুতে চলে গেল। আমার আগাগোড়াই লোয়ার বার্থ পছন্দের। সুযোগ পেলেই দখল নিয়ে বসি। তার উপর আবার বৃষ্টি ভেজা রাত। ট্রেনের জানলা দিয়ে অনবরত হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট ঢুকছিল। লোয়ার সিটে শুয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। দেখলাম ট্রেন এক অনামী স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্টেশনের নামটা দেখতে পেলাম না চেষ্টা করেও। এর পর আর ঘুম আসেনি। ব্যাগ সামলেই রাত কাটিয়ে দিয়েছিলাম।

যখন পরিকল্পনা চলছি তখন গো-চালা ট্রেক করব শুনে আমার এক অভিজ্ঞ দাদা বলেছিলেন, শুরুতেই গো-চা-লা…! আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ গো, গো-চালা…’ যেখানে রাস্তা দুর্গম, প্রতি পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি, জোঁক নিয়ে সংসার আরও ইত্যাদি ইত্যাদি রয়েছে, সেখানেই যাব আমি।

১৬ অক্টোবর ভোর ভোর এনজিপিতে প্রায় সময়েই ট্রেন পৌঁছাল। ট্রেন থেকে নেমেই সোজা কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন সেরে নিলাম। তার পর টুকটাক জলখাবার সেরে গাড়িতে উঠে পড়লাম। এদিন আমাদের সঙ্গে ছিল ট্রেক গাইড বালি হাং। কথায় কথায় ভাব জমল। বয়স বলল মাত্র ২১ বছর। এই বয়সে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুড়ি যেন উপচে পড়ছে।

গোচালা নিয়ে টুকটাক পড়াশোনা করে গিয়েছিলাম। কোন কোন পথে, কী ভাবে এগিয়ে যাব তা আরও একবার মিলিয়ে নিলাম বালির সঙ্গে। বালিও এই পথে ট্রেকিংয়ের তার অভিজ্ঞতার অনেক কথা শোনাল। বেশ লাগছিল শুনতে। মনে হচ্ছিল এই অভিযান না করলে আমার জীবনটাই বৃথা হয়ে যেত। কিন্তু তখনও জানতাম না আমাদের সঙ্গে কী হতে চলেছে…!

অভিযানের এই প্রথম দিনের ঝক্কিটাও কম ছিল না। যতই রোদ ঝলমলে আবহাওয়া হোক না কেন, ৮-৯ ঘণ্টার যাত্রাপথ সহজ নয়। সকলের কোমর ধরে এসেছিল। সকাল ন’টায় গাড়িতে উঠি এবং গাড়ি গিয়ে যখন ইউকসামে পৌঁছায়, তখন ঘড়িতে সাড়ে ৬টা পেরিয়ে গিয়েছে।

হালকা বৃষ্টি দিয়ে ইউকসাম আমাদের স্বাগত জানাল। সেই অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল পাহাড়গুলোর মাথায় কালো মেঘের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতের আড্ডা সেরে যখন ঘুমাতে যাব, দেখলাম সেই মেঘ পুরো গ্রামকে গ্রাস করেছে। এই মেঘ কিসের সংকেত? আমাদের মনের কোণেও যেন তখন সিঁদুরে মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

পরের দিন সকালে মেঘ কেটে গিয়েছিল। তার পরের দিন আমাদের ট্রেক শুরু হবে। তাই ট্রেক শুরুর আগের দিনে সুযোগ পেয়ে আশপাশের জায়গাটা পায়ে হেঁটেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। ডুবডি মনেস্ট্রি, কর্নেশন থ্রন অব নরবুগাং, কাথক লেক ঘুরে দেখলাম। এই সুন্দর সুন্দর জাগয়াগুলি নিয়ে পরে বিস্তারিত জানাব আপনাদের। ওই দিনটা বেশ ভালই কাটল ঘুরে ফিরে সেই দিনটা। কিন্তু যতটা ভালয় ভালয় দিন কাটল, রাতটা তা আর হল না। রাত্রে ফের বৃষ্টি নামল। চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল টিম লিডারের কপালে। আগামিকাল কী হতে চলেছে কে জানে!

কাথক লেক, ইউকসাম।

১৮ অক্টোবর… শুরু হচ্ছে আমাদের পাহাড়ে চড়া। সকালে একটু শরীর চর্চা, ব্রেকফাস্ট এবং কিছু অফিসিয়াল কাজকর্ম সেরে নেওয়া হল নিয়ম মাফিক। তার পর প্রায় ১০ কেজি ওজনের রুকস্যাকটা পিঠে চাপিয়ে নিলাম। এবার আকাশের মেঘকে ছোঁয়ার পালা… আর পিছন ফিরে তাকাব না…।

প্রথম ট্রেক, প্রথমবার সামনে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যেন ছোঁয়ার সুযোগ। আবেগ বাষ্প হয়ে চোখের জলে পরিণত হচ্ছিল। উঠতে শুরু করলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। এদিন আমাদের গন্তব্য ছিল সাচেন। বেস থেকে যাত্রা পথের দৈর্ঘ ধরলে ১০ কিমি। বৃষ্টি প্যাচপ্যাচে, শ্যাওলা ধরা দুর্গম রাস্তা।

এই পথে আমাদের সঙ্গী জোঁক, ঘন অরণ্য, মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেই ঝিঁঝিঁর ডাক, মাতাল করা শ্যাম বনানীর শোভা আর কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস্। পথে অবশ্য দুটো ঝুলন্ত ব্রিজও পেয়েছিলাম। আদিম জঙ্গলি সভ্যতা, সোঁদা মাটির গন্ধ, শহুরে কোলাহল থেকে যেন কয়েক আলোকবর্ষ দূরে চলে এসেছি। এখানে এখন ঝরাপাতার মরশুম চলছে জঙ্গল জুড়ে। 

এই পথে চলতে হাজার বিপদ। একটু অন্যমনস্ক হলেই পা হড়কে খাদে। তাই আমাদের গাইড বার বার সতর্ক করছিল। চলতে চলতে আমি ছোট করে এক বার পা হড়কালামও। সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলাম। পথে উতরাইয়ের হদিশ নেই, চড়াইয়ের পর চড়াই, উঠেই চলেছি। এ যেন শেষই হয় না।

সাচেনে পৌঁছনর আধ ঘণ্টা আগে থেকে ফের বৃষ্টি নামল। দুপুর নাগাদ সাচেনে ক্যাম্প সাইটে পৌঁছাতেই দেখি আমাদের মতো আরও বহু টিম সেখানে হাজির হয়েছে। আমাদের পিছনে পিছনেও কয়েকটা টিম এসে পৌঁছল। সেখানে বহু মানুষের সমাগম। এখানে ওখানে সেখানে… যে যেখানে জায়গা পাচ্ছে তাঁবু খাটাচ্ছে। আমরাও তাই করলাম।

সেদিন আমরা সাড়ে ৩-৪ ঘণ্টার ট্রেক রুট কভার করেছিলাম। শরীরে ক্লান্তি আর মনে এক অদ্ভুত আনন্দ ভরে রয়েছে। কিন্তু সেই আনন্দে যেন জল ঢালার প্রস্তুতি চলছি। একটু বিকেলের দিকে ফের শুরু হল অঝরে বৃষ্টি, বিরাম নেই যেন। আলোও কমে এসেছে, কাঁপিয়ে দিচ্ছে শীত। আমরা পাঁচ জনে দুটো তাঁবুতে ভাগাভাগি করে রইলাম।

গাইডের তাঁবুতেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এই সব অভিযানে। আমরা যেখানে তাঁবু খাটাতে পেয়েছিলাম সেখান থেকে গাইডের তাঁবু ছিল প্রায় তিন চারশো মিটার দূরে। সাধারণ সমতলে এই দূরত্ব কোনও সমস্যার বিষয় না হলেও এটা ছিল বৃষ্টি ভেজা পিছল পাহাড়ি রাস্তা। যা রাতের বেলা চরম বিপদে ফেলতে পারে।

প্রথমে মনস্থির করেছিলাম রাতের খাবারটা গাইডের তাবুতেই সারব। কিন্তু চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটল যা দেখে আর সেই সাহস দেখানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। প্রথমে কাদা পথে একটু এগোতেই দেখলাম যে ভদ্রলোকের সঙ্গে কয়েক মিনিট আগে কথা বলছিলাম, তিনি বৃষ্টি-জল-কাদার মধ্যে পথ খুঁজতে গিয়ে আছাড় খেয়েছেন।

এই সব দেখে আমি ভেবে দেখলাম অতিরিক্ত পোশাক যখন নেই আমার কাছে, কাদায় আছাড় খেলেই বিপদ। যতই পেটে খিদে থাক, গামছা বেঁধে রাতে ঘুমাব ঠিক করলাম। যদিও সেই রাতে আমার কপালে অল্প কিছু খাবার জুটে গিয়েছিল। বিশ্বজিৎ দা গাইডকে বলে সামান্য ভাত-ডালের ব্যবস্থা করেছিল। একটা ছোট পাত্রে নিয়ে এসেছিল তাঁবুতেই। প্রকৃতির জরুরি ডাক ছাড়া সে রাতে তাবুর বাইরে কেউ পা রাখিনি আমরা। ঠাণ্ডায় গুটিশুটি মেরে বিনিদ্র আর উৎকণ্ঠায় রাত কাটল।

১৯ অক্টোরব, ভোরের আলো ফুটছে, কিন্তু বৃষ্টি ধারায় কোনও বিরাম নেই। সকালের জলখাবার, দুপুর, রাতের খাবার সবই তাঁবুতে আনানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। একটি তাঁবুতে সকাল দুপুর রাত্রে একটি মাত্র থালাতেই খাবার আসছি। আমাদের তাঁবুতে আমরা ছিলাম ৩ জন।

এক একটি তাঁবুর জন্য একটি থালাতেই ভাত-ডাল-তরকারি, কোনও বেলায় সুজির হালুয়া, কখনও আবার জলজলা ম্যাগি এসেছিল। তাকেই তিন জনে ভাগ করে খেয়ে যেন কোনও রকমে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। পেট ভরুক বা না ভরুক স্বাদ কেমন সে সব ভাবার কোনও চেষ্টাও আমরা করিনি। বাঁচার তাগিদ নিয়ে একটি থালাতেই তিন বেলা তিন জন মিলে ভাগাভাগি করে খেলাম।

অন্য দিকে সুব্রত এবং অমিত দা’রও একই হাল। দু’দিনে তাঁবুর সংখ্যা বেড়েছে। আশেপাশের তাবু থেকে দল বেঁধে গান, গল্পগাছা ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে পাচ্ছিলাম। তখনও পর্যন্ত আমাদের মনস্থির, প্রকৃতির চোখ রাঙানিতে পিছু হটব না। যা হবে দেখা যাবে। ট্রেক সম্পূর্ণ করেই বাড়ি ফিরব।

দ্বিতীয় দিনেও অবিরাম বৃষ্টি। সে দিনও সারা দিন তাঁবুতে কাটল। রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে বুঝলাম এবার তাঁবুতে জল ঢুকছে। অনবরত বৃষ্টির জলে মাটির আবরণ ধুয়ে পাথরের অংশ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এক দিকে আশা বৃষ্টি থামবে, ট্রেক কমপ্লিট করব। অন্য দিকে আশঙ্কা কী হয় কী হয়, সব চিন্তা নিয়েই কোনও রকমে ৩ জনে রাত কাটিয়েছিলাম।

সাচেনে তৃতীয় দিন। অল্প অল্প মেঘ কাটছে। মেঘ-পাহাড়ের আড়াল থেকে মিনিট খানেকের জন্য দেখা দিয়েছিল সূয্যিমামা। আমাদের মন ফের উৎসাহে ফুটতে শুরু করেছিল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ দেখলাম বৃষ্টিটা ধরেছে। ভাবলাম এই যাত্রায় আমাদের অভিযান রক্ষা পেয়ে গেল। তাই আর বিলম্ব নয়… দুপুর ২টো নাগাদ পরবর্তী গন্তব্য সোকার দিকে রওনা দিলাম।

সাচেনের পাহাড় ঘিরে ধরেছে মেঘ। ছবি: অরিজিৎ চৌধুরী।

কিলোমিটারের হিসাবে বড় দূরত্ব না হলেও প্রথম দিনের তুলনায় রাস্তা আরও সংকীর্ণ। আরও সতর্ক হয়ে হাঁটতে হচ্ছিল সবাইকে। সোকা দিকে কিছুদূর এগোতে প্রায় ২ দিন পর মোবাইলের সিগন্যাল এল। সবাই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। জানতে পারলাম আমাদের রাজ্যের দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গেও মারাত্মক বৃষ্টি হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় ধস নামার কারণে উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উত্তরাখণ্ডে ব্যপক বন্যা হয়ে গিয়েছে। বহু মানুষ মারা গিয়েছেন।

একই অবস্থা সিকিমেও। তবুও আমরা হার মানতে নারাজ। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম। সহযাত্রী অনেক ট্রেকারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কারোর অভিজ্ঞতা খুব ভাল, ভিউ পয়েন্ট ওয়ান থেকে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন মিলেছে। কারোর আবার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই বৃষ্টি ভেজা পথে তাঁরা আবার প্রাণ বাঁচাতে মাঝ পথ থেকেই নেমে আসছিলেন। আমরা তখনও হাল ছাড়িনি। আমরা এগিয়েই চলছিলাম। তবে মনে একটা ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।

ফিরে আসছিলেন এমন দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, রাস্তার ভয়ঙ্কর অবস্থা। গোটা ট্রেক রুটে একাধিক ওয়াটার ফ্লো জন্ম নিয়েছে। এই সব ক্ষুদ্র ঝর্ণার স্রোত বন্যার নদীর মতো। আমাদের দলে একটি মেয়ে (আমাকে) দেখে প্রথমেই তাঁরা বললেন, ‘এখন আপনাদের এই পথে পা না বাড়ানোই ভাল। তার উপর আমাদের সেখানে পৌঁছতে প্রায় রাত ১০টা বাজবে। এই পরিস্থিতিতে বুঝতে পারছিলাম রাস্তা যেমন ক্রমশ দুর্গম হচ্ছিল তেমন পরিস্থিতি তার থেকেও দ্রুত ঘোরালো হতে যাচ্ছে।

সাচেন থেকে ইয়াকসাম নামার পথ। ছবি: অরিজিৎ চৌধুরী।

হেড টর্চের উপকারিতা থাকলেও বুঝে উঠতে পাড়ছিলাম না বন্য জীবজন্তুর প্রকোপ কতটা হতে পারে, তার উপর জোঁকের উপদ্রব তো রয়েছেই। আমি বাদে, ৪ জনকে জোঁকের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

এর মাঝে হঠাৎ অরিজিৎ দা জানাল, কাদা রাস্তায় তাঁর জুতো পিছল খাচ্ছে। তাঁর পক্ষে দু’পা এগোনও দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। ফলে দিনের আলোয় যে রাস্তা নিয়ে আমরা চিন্তা করছিলাম কী ভাবে পার হব, রাতের অন্ধকারে তা কতটা ভয়ঙ্কর হতে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমান করছিলাম আমরা। সব রকম প্রতিকুল পরিস্থিত বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত বুকে হিমালয়ের একটা বড় পাথর চেপে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম, এই যাত্রায় অভিযান স্থগিত করে দেওয়াই মঙ্গল। বেঁচে ফিরলে পরে আবার হবে গোচালা জয়।

এতটা কাছে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে। কিন্তু এমন কত রাত কেটেছে একের পর এক এক্সপিডিশনের ভিডিয়ো দেখে। আর আজ সেই স্বপ্নকে ছুঁতে চাওয়ার আগেই তা ভেঙে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাগে, কষ্টে অভিমানে হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল যেন। প্রলয়ের আগে যে থমথমে পরিবেশ তৈরি হয় আমার মধ্যেও তা যেন গুমরে গুমরে উঠছিল। শুধু বহির প্রকাশ ঘটেনি। আসলে কার উপর রেই রাগ দেখাব সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রকৃতি না চাইলে আমরাই বা কী করতে পারি… এই বলেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু তাতে কি আর এই কষ্ট কমার। বার বার গলা শুকিয়ে আসছিল। প্রথম প্রেম ভাঙার কষ্টের থেকেও সেদিন বেশি কষ্ট হচ্ছিল। আমার স্বপ্নকে পাহাড়ের কোলে গচ্ছিত রেখে ফিরে আসতে হচ্ছে…। এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে।

সাচেন থেকে নামার পথে নজরে এল, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ওঠার দিন রাস্তায় দু-তিনটে ওয়াটার ফ্লো পেয়েছিলাম, সেই সংখ্যা এখন আরও অনেকগুলো বেড়ে গিয়েছে। সেই জায়গাগুলি সাবধানে পার না হলেই বিপদ। ফেরার পথেও বিপদ যেন এখানে ওখানে ওঁৎ পেতে রয়েছে। কিন্তু সেই সব ভয়ের থেকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট। শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই এই যাত্রায় ধীরে ধীরে সমতলে নেমে আসতে হল আমাদের। হয়তো পরে কোনও দিন ভাগ্য সঙ্গ দিলে ফের এক বার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ব রুকস্যাক নিয়ে। তখন এই অভিজ্ঞতা পাথেয় হয়ে থাকবে, পথ কিছুটা সহজ করে দেবে। ততদিন পর্যন্ত ফের গোচালা জয়ের স্বপ্নই জেগে থাক মনে।

পুনশ্চঃ প্রথম যেদিন লিখতে বসেছিলাম, ট্রেক করে ওঠা আর তাঁবুতে কাটানো দিনগুলোর কথা একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ভেবেই অবাক লাগছিল… কী নেশায় আমরা বেরিয়ে পড়ি অধরাকে ধরতে। এক অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছিল। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ট্রেকারদের কোনও জাত হয়ে না, লিঙ্গ হয়ে না। মহিলা পুরুষ বলে ভেদাভেদ কিছু হয় না। আপনি চাইলেই, মনের জোর থাকলেই বেরিয়ে পড়তে পারেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে অপার্থিব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হওয়া আর চলতি পথে নানা অভিজ্ঞতা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। জীবনে আর কী চাই বাবুমশাই?


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *