কৃষিজীবী সমাচার: আমনধানে শামুক কাঁকড়ার আক্রমণ নতুন নয়। বীজতলায় চারা বেরোনোর সাথে সাথেই শামুকের আক্রমণ শুরু হয়। এরা চারা গাছের পাতা খেয়ে ফেলে। কাঁকড়ার আক্রমণ বিশেষভাবে চোখে পড়ে ধান রোয়ার ঠিক পরে পরেই। কাঁকড়া সবেমাত্র রোয়া-পোঁতা করা ধান গাছের চারার পাতা কেটে দেয়। কাটা পাতাগুলো জলের উপরে ভাসতে থাকে। ধান জমিতে যে রোয়া-পোঁতা চরা চারা গাছ ছিল তা বোঝাই যায় না। একদম ফাঁকা মাঠ বা জমির মতো দেখতে লাগে।
এদের হাত থেকে বাঁচাতে ওই জমিতে চারা রোয়া পোঁতা করার ঠিক পর পরই একর প্রতি ৬ কেজি হারে তুঁতে বা কপার সালফেট (CuSO4) ছড়িয়ে দিন। এছাড়া ১৫০ গ্রাম মেটালডিহাইড, ৬ কেজি গমের ভূষির সঙ্গে মিশিয়ে এক একর জমিতে বিষটোপ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। এতে শামুক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কাঁকড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাল ফল পেতে শামুকের মাংসের সঙ্গে কার্বোফিউরান ৩ গ্রাম দানা ওষুধ মিশিয়ে বিষটোপ হিসাবে ব্যবহার করুন। ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসি বিঘা পিছু ২৫০ থেকে ৩০০ মিলি বালির সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে ছড়ালে অথবা কার্বোফিুরান ৩ গ্রাম হেক্টর প্রতি ৩০ কেজি ছড়ালে ভাল কাজ দেয়। রোগ বা কীটপতঙ্গের আক্রমণের থেকে ফসল রক্ষার ব্যাপারে আমাদের কৃষক বন্ধুরা আজকাল অনেক সচেতন। কিন্তু ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা বা আগ্রহ তার তুলনায় অনেক কম দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হল ইঁদুর কতটা ক্ষতি করে সে বিষয়ে সঠিক ধারণার অভাব।
ইঁদুর মাঠে, গুদামে এবং বাড়িতে সব জায়গায় আমাদের নানা ভাবে ক্ষতি করে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল, আমাদের দেশে যত খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় তার ৫ শতাংশ ইঁদুরের পেটে যায়। একটি ইঁদুর গড়ে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কেজির বেশি খাবার খায়। আমাদের দেশে জন প্রতি গড়ে ৫-৬টি ইঁদুর আছে। এক্ষেত্রে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ইঁদুর থত খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে।
কৃষি সংক্রান্ত খবরাখবরের জন্য আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন
ধানের জমিতে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়লে দেখা যাবে এরা অনেক পরিমানে ধান গর্তে সঞ্চয় করে রেখেছে। এছাড়া তারা ইঁদুর প্লেগ-সহ অন্যান্য রোগ ছড়ায়। জমির আল, সেচের নানা, বাঁধের মাটিতে গর্ত করে যথেষ্ট ক্ষতি করে। এক জোড়া স্ত্রী ও পুরুষ ইঁদুর থেকে এক বছরে ১২৭০টি ইঁদুর জন্মাতে পারে। ধান জমিতে সাধারণত তিন জাতের ইঁদুর পাওয়া যায়- মাঠের মেঠো ইঁদুর, কালচে ইঁদুর আর বড় ধেড়ে ইঁদুর।
ইঁদুর সাধারণত ধানের পাশকাঠি ছাড়ার সময় মাঠে বা আলে এসে বাসা বাঁধে। প্রথম অবস্থায় এরা দিনে প্রায় ২০টি গুছিকে আক্রমণ করে। পরে গর্ভাবস্থায় এরা প্রায় ৬০টি গুছিকে কেটে নষ্ট করে। পরবর্তীকালে ইঁদুর আধনের শীষ কেটে নিজেদের গর্তের ডেরায় চলে যায়। শস্য ভরা মাঠে ইঁদুরের আস্তানা বেড়ে যদি একর প্রতি ১০-২০টি হয় তখন ফসলের বিশেষ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। ইঁদুর যাতে ফসলে কম আক্রমণ করে সেই জন্য প্রথম থেকেই কতগুলি ব্যবস্থাপনা চাষের সময় বা তার আগেই নিতে হবে। যেমন-
ক) প্রতিবছর জমির আল ছাঁটা ও আল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং জমির আল সরু করতে হবে। মনে রাখা দরকার যে ইঁদুর সাধারণত আলে প্রথম বাসা বাঁধে।
খ) আলে বা জমিতে চাষের আগে কোথও ইঁদুরের গর্ত থাকলে তা বিনষ্ট করে দিন।
গ) ধান জমিতে রোয়া পোঁতার সময় ৮ সারি অন্তর ১ সারি ফাঁক রেখে ধআন লাগান। জমি সর্বদা আগাছা মুক্ত করার চেষ্টা করুন।
ঘ) ধান জমিতে প্রথম থেকেই পাখি বা পেঁচা বসার জন্য ডাল পুঁতে রাখুন।
কৃষি সংক্রান্ত খবরাখবরের জন্য আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন
জমিতে ইঁদুর আক্রমণ করার প্রথম অবস্থায় (বেশি পাশকাঠি ছাড়ার সময়) এদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা উচিৎ যাতে ধানে ফুল আসার সময় এদের সংখ্যা খুব না বেড়ে যায়। কারণ তখন এদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কষ্টকর। ফসলের মাঠে ইঁদুর একক কৃষক ভাইয়ের চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ করা একেবারেই অসম্ভব। সেই কারণে চাই মাঠের সকল কৃষকের যৌথ উদ্যোগ।
ইঁদুর সাধারণত তিন ভাবে মারা যেতে পারে- ১) ফাঁদের ব্যবহারে ২) বিষ টোপের ব্যবহার করে ৩) অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেটের (বিষাগ্যাস) ব্যবহার।
১) ফাঁদের ব্যবহার: আক্রমণের প্রথম অবস্থায় ইঁদুর ধরার বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরা যায়। এরা যে রাস্তায় চলাচল করে তার কাছাকাছি আড়াআড়ি ভাবে ফাঁদ পাতুন। ফাঁদের ইঁদুর অন্য জায়গায় ছেড়ে না দিয়ে মেরে ফেলা উচিৎ। প্রতিবার ফাঁদটি পরিষ্কার করে এবং সম্ভব হলে ধুয়ে, শুকিয়ে পুনরায় ব্যবহার করুন। ফাঁদে ইঁদুরের গন্ধ থাকলে ইঁদুর আসতে চায় না।
কৃষি সংক্রান্ত খবরাখবরের জন্য আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন
২) বিষটোপের ব্যবহার:
ক) জিঙ্ক ফসফাইড বিষটোপ- জিঙ্ক ফসফাইড একটি মারাত্বক বিষ যা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দিয়ে মেরে ফেলে। তবে এই বিষটোপ প্রয়োগ করার আগে বিভিন্ন জায়গায় ৩-৪ দিন বিষ ছাড়া টোপ দিন। লক্ষ্য করুন, ওই বিষহীন টোপ ইঁদুর খাচ্ছে কিনা। এর পর বিষযুক্ত টোপ বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগ করুন, ভাল কাজ হবে। টোপ নারকেলের মালার গর্তে বা কোনও কাগজে মুড়ে রাখুন। খালি জায়গায় ছড়িয়ে বা এক জায়গায় জড়ো করে দিলে ইঁদুর ভাল খেতে পারে না। বিষটোপ প্রয়োগের পরদিন থেকেই ইঁদুর মারা যায়। ওই বিষটোপের কার্যকারিতা সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায়। প্রতণবার বিষটোপ ব্যবহারের পর বেশ কিছুদিন আর ওই বিষটোপ ব্যবহার করবেন না। এক একর জমির জন্য ১৫ গ্রাম জিঙ্ক ফসফাইড বিষের প্রয়োজন। জিঙ্ক ফসফাইড বিষটোপ তৈরির উপাদান ও পরিমান সারণীতে দেওয়া হল।
ক্রমিক সংখ্যা | উপাদান | শতকরা ভাগ | ১০০ গ্রামে পরিমাণ |
১ | গমের আটা | ৪৮ | ৪৮ গ্রাম |
২ | চালের গুঁড়ো | ৪৮ | ৪৮ গ্রাম |
৩ | খাবার জল | ২ | ২ গ্রাম |
৪ | জিঙ্ক ফসফাইড বিষ | ২ | ২ গ্রাম |
খ) ব্রমাডায়ালোন বিষটোপ: ব্রমডায়ালোন বিষটোপ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রক্ত সঞ্চালনের বাধা সৃষ্টি করে এবং মস্তিষ্কে রক্তখরণ ঘটিয়ে মেরে ফেলা। এই বিষটোপ আস্তে আস্তে কাজ করে। মৃত্যুর আগে ইঁদুর ঝিমোতে থাকে। বিশেষ নড়াচড়া করতে পারে না। এগুলি সরাসরি একেবারেই ইঁদুরের গর্তে বা চলাচলের জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে।
৩) অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেটের ব্যবহার: অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট থেকে বিষ গ্যাস যেমন ফসফিন গ্যাস নির্গত হয়। এটি ইঁদুরকে মেরে ফেলে। গুদামঘরে ও জমিতে ইঁদুরের গর্তে এই ট্যাবলেট ব্যাবহার করা যেতে পারে। দিনের বেলায় ইঁদুরের গর্তে ফসফইড ট্যাবলেট ঢুকিয়ে দিয়ে (একটি গর্তে একটি ট্যাবলেট) গর্ত মাটি দিয়ে উপরথেকে বন্ধ করে দিন। গর্তের ভিতরে থাকা ইঁদুর বিষ গ্যাসের (ফসফিন) প্রভাবে মারা পড়বে।
কৃষি সংক্রান্ত খবরাখবরের জন্য আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ দিতে এখানে ক্লিক করুন
ডক্টর সীতেশ চট্টোপাধ্যায়, সহকারী কীটতত্ত্ববিদ।
ডক্টর চিরশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, সহকারী কীটতত্ত্ববিদ।
শ্রীমতী পূর্ণিমা হালদার, ধান্য শারীরতত্ত্ববিদ, ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, চুঁচুড়া, হুগলি।
সৌজন্যে- সার সমাচার।