টোপ বিজ্ঞাপনের, ইতিবাচক খবরেই ইতি প্রকৃত সাংবাদিকতার, পলাশ মুখোপাধ্যায়ের কলম

Share with Friends

পলাশ মুখোপাধ্যায়।

“ইতিবাচক খবর করুন, অবশ্যই বিজ্ঞাপন পাবেন”। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহশীল এই বাক্যের মধ্যে কিন্তু স্নেহ ছাড়াও লুকিয়ে আছে খানিক দম্ভ, খানিক হুমকি এবং সমালোচনা সহ্য করতে না পারার এক চিরাচরিত সংমিশ্রণ। শাসকের অহং, দিনের আলোর মতই স্পষ্ট এই বাক্যে।

সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য এমন সরাসরি বিধি নির্দেশ এর আগে কোনও শাসকের গলায় আমি অন্তত শুনিনি। সমালোচনা কেউই পছন্দ করেন না। সাংবাদিকতার প্রথম দিকে বাম তথা সিপিএমের আমলেও তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। কোনও খবর বিপক্ষে গেলেই বাম নেতারা দেখা হলেই তা নিয়ে নানা কটুক্তি বা কটাক্ষ করতেন। প্রচ্ছন্ন হুমকিও যে পাইনি তা নয়, কিন্তু সরাসরি আমাদের পক্ষেই খবর করতে হবে, তার বিনিময়েই আমরা বিজ্ঞাপন দেব এটা অন্তত বামেরাও বলেনি। ঠারেঠোরে বোঝালেও প্রকাশ্য সভায় এমন কথা বলার মত দুর্মতি তাদের হয়নি।

কিন্তু আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সোজা সরল। তিনি তাই সোজা কথা সোজা ভাবেই বলে থাকেন। তাই বলে নিজেদের পক্ষে খবর করলেই সরকারি বিজ্ঞাপন মিলবে, এটা বোধহয় সাম্প্রতিক কালে সব চেয়ে উদ্ধত উক্তির মধ্যে একটি। সংবাদ পত্রের অনেকটাই অর্থ আসে সরকারি বিজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি থেকে। ছোট পত্রিকা তো বটেই সরকারি বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে থাকে বড় বড় সংবাদপত্রও।

বহু সংবাদ মাধ্যমই তাই সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করতে কার্যত ভয়ই পায়, পাছে সরকারি বিজ্ঞাপন হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই পাঠকরা সরকারের বিপক্ষে তেমন খবর অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যম থেকেই পান না। এরই মাঝে কেউ কেউ একটু আধটু সাহস দেখাতো, মুখ্যমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর তারাও আর সেই সৎসাহস দেখাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ।

উত্তর ২৪ পরগনার প্রশাসনিক সভায় স্থানীয় এক সংবাদ পত্রের প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়ার অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তারই উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন সরকারের পক্ষে খবর করলেই মিলবে বিজ্ঞাপন। “যে গ্রামীণ পত্রিকাগুলো সরকারের ডেভলপমেন্ট কাজ পজিটিভলি, পজিটিভ ভাবে করবেন, আমি ডিএমকে বলব, তাদের যেন আমরা বিজ্ঞাপনটা দিই।”

শুধু তাই নয়, পাশাপাশি তার মন্তব্য “ইতিবাচক কাজ নিয়ে খবর করে প্রতিদিন একটা করে কপি ডিএম অফিসে পাঠাবেন। ডিআইসিওকে পাঠাবেন। পুলিশের এসপি এবং পুলিশ কমিশনারেটকে পাঠাবেন। কারণ, তারাও দেখে নেবে যে ইতিবাচক খবর হচ্ছে। একটা নেতিবাচক জিনিসকে ইতিবাচক করা যায়। যত ইতিবাতক খবর, তত বিজ্ঞাপন। কারণ আমি চাই, তারা ভাল জিনিসগুলি তুলে ধরুক। বাংলায় সারা দিন নেতিবাচকই লক্ষ্য করি। ইতিবাচক খবরটা কেউ আর করে না। ইতিবাচক খবর করুন, বিজ্ঞাপন নিশ্চয় পাবেন।’ অর্থাৎ এখন খবর করে সেই খবরটি সরকারের পক্ষে হয়েছে কিনা, তা সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে তা পাশ করিয়ে নিতে হবে। তবেই বুঝুন সরকারের বিপক্ষে আর কোনও খবর আপনি পড়তে পারবেন কিনা তা এখন থেকে যথেষ্ট প্রশ্নের মুখে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই সমস্যা নেই। কারণ তিনি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন না। সাংবাদিক সম্মেলনও করেন না। মাঝে মধ্যে তার মন কি বাত তিনি প্রকাশ করেন, সাংবাদিকেরা সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে প্রচার করে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর সেই সমস্যা নেই। তিনি এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উল্টো মেরুতে, যথেষ্ট সময় দেন সাংবাদিকদের। প্রচুর সাংবাদিক সম্মেলন করেন। কিন্তু সমালোচনা একেবারেই নিতে পারেন না। পছন্দ করেন না বিরুদ্ধাচারণও। তাই তো তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেই সেই সাংবাদিককে প্রকাশ্যেই অপমান করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে কথাই বলতে দেন না তার মনে হওয়া বিরোধী সাংবাদিকদের।

এ পর্যন্তও চলছিল এক রকম। কিন্তু সংবাদপত্র কি খবর করবে? অথবা কি খবর করলে পরেই সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে এই নির্দেশ এমন প্রকাশ্যে সরাসরি তিনি না দিলেই বোধহয় ভাল হত। জেলার ছোট কাগজগুলির সরকারি বিজ্ঞাপন প্রয়োজন, অনেক কাগজই পয়সার অভাবে ধুঁকছে, কিছু বন্ধও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার জন্য এমনিতেই তিনি জেলা প্রশাসনকে কোনও সুস্থ নির্দেশ দিতেই পারতেন। তার স্নেহশীল দিদিময়ী ভাব যথেষ্টই প্রকাশিত হত সে ক্ষেত্রে। কিন্তু শুধুমাত্র সরকারের জন্য ইতিবাচক খবর করলেই বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে, এটা বলাটা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মানায় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই।

সংবাদপত্রই সরকারের বিভিন্ন ভুল ধরিয়ে দিত, সমালোচনা করত সাধারণ মানুষের হয়ে। কিন্তু এখন সে কাজও বন্ধ করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি। আগে সরকারি কর্মী বা আধিকারিকরা সাংবাদিকদের একটা আলাদা মর্যাদা দিতেন। এখন তাদের কাছ থেকেই খবর ইতিবাচক কিনা তা পাশ করাতে হবে। তারা কি আর সংবাদকর্মীদের সেই মর্যাদা দেবেন? এমনিতেই সাংবাদিকদের সম্মান এখন যথেষ্ট কমে গিয়েছে নানা কারণে। তার উপরে এখন মুখ্যমন্ত্রীর এই নির্দেশের পর সাধারণ মানুষও কি সাংবাদিক তথা সংবাদ মাধ্যমের আর ভরসা রাখতে পারবে?


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *