
একজন সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি কথাই বলেন না। অপরজন প্রচুর কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রকৃত মর্যাদাটাই ভুলে গিয়েছেন। প্রথমজন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, দ্বিতীয় জন আমাদের রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিককুলের প্রায়শই ক্লাস নেন। কি করা উচিৎ, কি লেখা উচিৎ, কোনটা লেখা বা দেখানো উচিৎ নয় এ নিয়ে প্রতিনিয়িত স্পষ্ট নির্দেশিকা সাংবাদিকদের উদ্দেশে জারি করেন প্রকাশ্যেই। এর আগেও সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বক্তব্য রাখার সময় কেন সাংবাদিকরা কেন তার বক্তব্য লিখে রাখছে না, তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তাঁকে বলতে শোনা যায় “কেউ কিন্তু কিছুই লিখছে না, আমি সব দেখছি”। ভাবুন তাহলে, কথা শুনলেই মনে হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিদিমণি তার ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বকুনি দিচ্ছেন।
কয়েক দিন আগেই তিনি সাংবাদিকদের কাজ এবং নীতি নিয়ে গুরুগম্ভীর ভাষণ দিয়েছেন। এমনকি সংবাদ মাধ্যম সরকারের সমালোচনা করলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, সংবাদ না দেখে সিরিয়াল দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সাধারণ মানুষকেও। অর্থাৎ একটা বিষয় পরিষ্কার, মুখ্যমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে তার বশংবদ হিসেবে দেখতেই পছন্দ করেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে যে সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশ্য বা প্রত্যক্ষ সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন, তার লড়াইয়ের প্রতিটি ধাপ যে সংবাদ মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রকাশের ফলে ধীরে ধীরে তার স্বপক্ষে জনমত তৈরি হয়েছিল, সেই সংবাদ মাধ্যমই আজ তার আক্রমণের মুখে। তিনি শাসক, তিনিই ঠিক, এই প্রাচীন জটিল অনিরাময়যোগ্য অসুখ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি মাননীয়াও।
তার এই সংবাদ মাধ্যম নিয়ে প্রকাশ্য উক্তিতে যথেষ্ট আলোড়ন পড়ে। যদিও বাংলা সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশই তার অনুগত। তার উপরে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির পরে ছোটখাটো সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করবার আর সাহস দেখাচ্ছে না। তবুও সামাজিক মাধ্যমে বা কিছু বিপরীত মেরুর সংবাদ মাধ্যমে এই নিয়ে বেশ শোরগোল পড়ে। এবার তারই ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গিয়ে ফের সংবাদ মাধ্যমকে বা সাংবাদিকদের আর এক প্রস্থ অপমান করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
না, তিনি উপকারই করতে চেয়েছেন। অনেক সাংবাদিকই খুব কম মাইনে পান, তাই তাদেরকে পুলিশের সোর্স করবার নিদান দিয়েছেন পুলিশ কর্তাদের। অর্থাৎ সাংবাদিক এবার থেকে খোঁচর বা পুলিশের চর হিসেবে কাজ করবেন, তার বিনিময়ে কিছু টাকাও পাবেন। মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্য, সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই পুলিশের চেয়েও আগে খবর আসে, কিন্তু তাদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, তাই পুলিশ ওই সাংবাদিকদের সোর্স হিসেবে কাজে লাগাতেই পারে। বুঝুন একবার, একজন ভাল সাংবাদিকের কুশলতা, খবরের নেটওয়ার্ক টিকে থাকে তার নিজস্ব সোর্সের কারনে। যার সোর্স যত বেশি সেই সাংবাদিকের কৃতিত্বও তত বেশি। এবার সেই সাংবাদিককেই সোর্স বানিয়ে দেওয়া হল, প্রকারান্তরে কিছু অর্থের বিনিময়ে নিয়ে নেওয়া হল তার তিল তিল করে বানানো নেটওয়ার্ক বা খবরের সোর্সকে।
সাংবাদিকের খবরের সোর্স তার অহংকার, তার শক্তি, তার লড়বার অস্ত্র। সেটা বিক্রি হয়ে গেলে আর থাকে কি? যে পুলিশ প্রশাসন এই সোর্সের কারনেই সাংবাদিকদের সমীহ করে থাকেন, গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তারাও তখন সাংবাদিকদের বস হয়ে বসবেন। আর বসের বিরুদ্ধে কোনও খবর আপনি আমি আর নিশ্চয় পাব না। তাই বলে কি সাংবাদিকেরা কোনও খবরই পুলিশকে দেন না, নিশ্চয় দেন। আমি নিজে সাংবাদিক হওয়ার সূত্রে অনেক সময়ই নানান খবর পুলিশকে দিয়েছি, পুলিশের কাছ থেকে নিয়েওছি। সেটা সকলেই করেন। পুলিশের সঙ্গে সাংবাদিকের সখ্যতাও রয়েছে প্রায় সর্বত্রই। বহু পুলিশ কর্মী বা আধিকারিকের সঙ্গে সাংবাদিকদের সুসম্পর্কের অসংখ্য উদাহরণ মেলে। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যেই আছে একটা পারস্পরিক সমীহ, শ্রদ্ধা, কিছুটা ভালবাসা কিছুটা পেশাদারিত্ব মেশানো সুস্থ সম্পর্ক। কিন্তু এটাই যখন সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে সংবাদ কেনাবেচার কারবার হয়ে দাঁড়াবে তখন এ সম্পর্ক এতটা সুস্থ, এতটা সমীহপূর্ণ থাকবে তো?
এর আগেও জেলার ছোট কাগজ বা পত্রিকাগুলিতে সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য জেলাশাসক সহ পদস্থ আধিকারিকদের অনুমোদন নিতে হবে বলে বিতর্ক বাড়িয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার বক্তব্য ছিল জেলার ছোট কাগজগুলি সরকারের পক্ষে লিখছে কিনা তা দেখে তবেই বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুপারিশ করবেন সরকারি আধিকারিকেরা। অর্থাৎ সরকার বিরোধী লেখা মুশকিল, পাশাপাশি সরকারের পছন্দ না হলে বিজ্ঞাপন বন্ধ। জেলার ছোট কাগজের সাংবাদিকদের এক্ষেত্রে সরকারি আধিকারিকদের দাক্ষিণ্যে নির্ভর করতে হবে, বিজ্ঞাপন নেওয়ার কারণে। আবার মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ মত এই সোর্স প্রথা চালু হলে পুলিশ আধিকারিকদের দাক্ষিণ্যেও নির্ভরশীল হতে হবে। জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা সরকারের সংবাদ মাধ্যমের উপরে খবরদারীর সমালোচনা হয় এখনও। সেটা তো ছিল কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু অনির্দিষ্ট কালের জন্য এই সংবাদ মাধ্যমের উপরে নজরদারী, সরকারি চাপ সৃষ্টির অপচেষ্টাকে কি বলবেন আপনি?