Mid Day Meal: চুরি যাচ্ছে পুষ্টি, পলাশ মুখোপাধ্যায়ের কলম

Share with Friends

পলাশ মুখোপাধ্যায়।

বছর দুয়েক আগের কথা। বাংলার অন্যতম পরিচিত পর্যটন স্থল বড়ন্তি গ্রামের শেষ প্রান্তে থেমেছি সামনের জলাধারে থাকা পদ্মের ছবি তুলব বলে। জলের ধারেই সুন্দর পরিবেশে একটি ছোটখাটো প্রাথমিক স্কুল। ঘণ্টা পড়তেই হৈ করে হৈ স্কুল থেকে বেরিয়ে এল শ খানেক শিক্ষার্থী। তাদের পিছনে তিন জন শিক্ষক শিক্ষিকা। ঐটুকু স্কুলে এত ছেলেমেয়ে আশা করিনি। শিক্ষক শিক্ষিকাও গ্রামের মানুষ, আলাপী।

আমায় দেখে কোথা থেকে আসছি, কি করি এসব নানা কথার মাঝে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনাদের স্কুলে তো অনেক ছাত্র ছাত্রী। ওরা জানালেন গ্রামের স্কুলে এমনিতেই ছাত্র ছাত্রী বেশিই থাকে। কারণ একবেলা খাবারের এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। তার উপরে আজ ডিম ছিল, ডিম থাকলে সেদিন উপস্থিতিও অন্যদিনের তুলনায় বেশিই থাকে। বাড়ি ফেরা ছেলেমেয়েদের মুখেও দেখলাম বেশ তৃপ্তির খুশি।

সেই ডিম এখন আর মিড ডে মিলে থাকে না। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ডিম সরে গিয়েছে বছর খানেক হল। এর পিছনেও একটা গল্প আছে। হুগলীর একটা স্কুলে মিড ডে মিলে নুন ভাত খাওয়ানোর ছবি প্রকাশ করেন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। তার পরেই হুগলীর তৎকালীন জেলাশাসক তৎপর হন, জেলার সব স্কুলে মিড ডে মিলে সাত দিন সাত রকম পদের কথা জানান। যেখানে মাছ, মাংস এবং ডিম তিনটেই দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

এটা দেখে উৎসাহিত হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর সহ আরও কয়েকটি জেলাও একই ঘোষণা করে। ব্যস এতেই চটে যান মুখ্যমন্ত্রী, পূর্ব বর্ধমানের প্রশাসনিক সভায় তিনি সাফ জানিয়ে দেন এই নির্দেশ তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়নি, সুতরাং এটা বাতিল। মিড ডে মিলে ডিম দেওয়ার মত অর্থ তাদের নেই। মন্ত্রী আমলার যুদ্ধে বঞ্চিত হল শিশুরা। বিতর্ক উস্কে দিয়ে কেউ বলতেই পারেন যে পুজো কমিটিকে না চাইতেই টাকা দেওয়া যায়। ক্লাবগুলিকে দান করা যায় প্রচুর টাকা। কিন্তু নতুন প্রজন্মের পুষ্টির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নিদান “ আমি বলছি, মিড ডে মিলে ভাত-ডাল আরেকটা তরকারি পেট ভরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন”।

আর একটা মজার কথা বলি। বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে আগে হঠাৎ মিড ডে মিলের পরিমান মাথাপিছু বেড়ে যায়। কোভিড সতর্কতায় গত বছর স্কুল বন্ধ হওয়ার পর মিড ডে মিলের খাদ্য সামগ্রী বিতরণ শুরু করে রাজ্য। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের হাতেই তা তুলে দেওয়া হচ্ছে।

গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত চাল, আলু, এবং সাবান দেওয়া হলেও। মার্চ থেকে অভিভাবকদের প্যাকেটে যোগ হয় এক কিলো ছোলা, ৫০০ গ্রাম চিনি, ২৫০ গ্রাম ডাল, এবং ২০০ গ্রাম সোয়াবিনের প্যাকেট। এবার আসল মজা হল ভোট মিটে যেতেই জুন মাস থেকে ফের কমে গিয়েছে এই পরিমান। চিনির পরিমাণ ৫০০ গ্রাম থেকে কমিয়ে আড়াইশো গ্রাম করা হয়েছে। সোয়াবিন এর পরিমান কমিয়ে করা হয় ১০০ গ্রাম। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ছোলা। সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ সয়াবিনও। এবার যদি নিন্দুকেরা বলেন যে ভোট পেতেই মিড ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল, খুব ভুল হবে কি?

এ তো গেল আমাদের রাজ্যের কথা। ধোয়া তুলসি পাতা নয় কেন্দ্রের সরকারও। মিড ডে মিলে কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ ভাবে খরচ করে। ২০১৪ সালে যখন মোদি সরকার ক্ষমতায় আসে তখন এই প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছিল ১৩,২১৫ কোটি টাকা। পরের বছরই তা কমিয়ে প্রায় অর্ধেক, ৭৭৭৫ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়। তার পরে তা আর খুব একটা বাড়েনি।

বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুষ্টি বা বিকাশে মোদি সরকারের সদিচ্ছা কতটা। এখন মিড ডে মিলের নাম বদলে পি এম পোষণ রেখে সেই মিড-ডে মিল প্রকল্পেরই কৃতিত্ব নিতে চাইছেন মোদি। সেন্ট্রাল ভিস্তার জন্য টাকার অভাব হবে না, জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রের সরকার।

কিন্তু সেন্ট্রাল ভিস্তার মত প্রকল্প যারা পরে এসে ভোগ করবে তাদের স্বাস্থ্য বা পুষ্টির বিকাশে সামান্য অর্থও বৃদ্ধিও বাজেটে দেখা যায় না। শিশুদের পুষ্টির জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বার বার বলে এসেছেন বিভিন্ন সংগঠনের মানুষ, শিক্ষক শিক্ষিকারা। কিন্তু একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করেই দায় এড়িয়েছে দুই সরকার।

অথচ ১৯৮০ সাল থেকে এই প্রকল্প সার্থক ভাবে নিজেদের দায়িত্বে পালন করে এসেছে তামিলনাড়ু। তাদের সঙ্গেই আসবে কেরলের নামও। আমাদের রাজ্য যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল এ ব্যাপারে, এখনও আছে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী দয়ালু, কন্যাশ্রী, সবুজসাথীর মত এক রাশ প্রকল্পে প্রচুর অর্থ খরচ করছেন তিনি। অথচ শিশুদের সপ্তাহে অন্তত দুটি করে ডিম দিতে হলে খুব সাংঘাতিক কিছু খরচ কি বেড়ে যেতো? কিন্তু সামান্য ইগোর লড়াইয়ে আজ আমাদের শিশুরা বঞ্চিত।

আরও খারাপ অবস্থা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেরও। যে শিশুদের প্রতি দিন খিচুড়ি, অন্তত আধখানা ডিম, সব্জি-সয়াবিন, ছাতু-গুড়ের লাড্ডু পাওয়ার কথা, তাদের জন্য অতিমারি কালে ‘আইসিডিএস ডিরেক্টরেট’ বরাদ্দ করেছে গোটা মাসে দু’কেজি চাল, দু’কিলো আলু আর তিনশো গ্রাম মুসুর ডাল। গত জানুয়ারি মাস থেকে তাও বন্ধ। গ্রামাঞ্চলে যে স্কুলগুলি খিচুড়ি স্কুল নামেই পরিচিত ছিল সেই স্কুলে এখন খিচুড়ি দেওয়া তো দূরে থাক, বহু জায়গায় তালাই খুলছে না। 

বড়ন্তির সেই স্কুলের মতই আমাদের রাজ্যে হাজার হাজার স্কুলের শিশুদের সহায় মিড ডে মিল। শহরাঞ্চলে কিছু কিছু স্কুলে মিড ডে মিল তেমন জনপ্রিয় না হলেও একটু গ্রামের দিকে বহু পরিবারের শিশুদের দুপুরের খাবারের প্রধান বা একমাত্র সম্বল এই মিড ডে মিল। কারও কারও হয় তো ওই একবেলাই খাবার জোটে। সেই খাবারটুকু থেকেও ডিম সয়াবিন প্রভৃতি কেড়ে নেওয়া হলে এই সব শিশুদের পুষ্টি থাকে না বললেই চলে।

অতিমারির এই সময়ে বরং তাদের বেশি করে এখন পুষ্টিকর খাবার দরকার। কিন্তু শিশুরা ভোট দেয় না, এদের অতিসাধারণ বাবা মায়েরাও উচ্চস্বরে রা কাড়েন না কখনই। তাই অনেকটা উপেক্ষিত আমাদের এই ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য ভাবার কেউ নেই। এগুলি নিয়ে বিধানসভা বা লোকসভায় কোনও হৈচৈ হয় না। কোনও রাজনৈতিক নেতা এই সব সামান্য কারণ নিয়ে কিছু বলেন না। তাই নিরবে নিঃশব্দেই অপুষ্টির আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে কলকাতার… থুড়ি পশ্চিমবঙ্গের যিশুরা।


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *