তেঁতুল কথা: লোকগাথা থেকে অর্থনৈতিক গুরুত্বের সাতকাহন ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তীর কলমে

Share with Friends

ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তী

বাংলার একটি প্রবাদ বাক্য হল, ‘যদি হই সুজন/তেঁতুল পাতায় ন’জন’। পারস্পরিক সমঝোতা আর সহাবস্থানই প্রচল-কথাটির মূল প্রতিপাদ্য। বাঙালি হিন্দুর মতো, ‘তিনটে মানুষ আর দুটো কালীপুজো’– এমন বিচ্ছিন্ন নয়। একটি বিরহড় লোককথা শোনাই। ‘রাম-সীতা-হনুমান’-এর গল্প। সেখানে তেঁতুল আর খেজুর পাতার অভিযোজনের গল্প।

রাম-লক্ষ্মণ-সীতা বনে চলে গেল। ক্রান্তীয় অরণ্যে তারা ‘উথ্লু’ বিরহড়দের মতো যাযাবরের জীবন কাটাতে লাগল। থাকত পাতার ছাওয়ায়, কুঁড়ে ঘরে। একবার একটা মস্ত বড় তেঁতুল গাছের তলায় ঘর তৈরি করল তারা। সেই সময় তেঁতুল গাছের পাতা ছিল মস্ত বড় বড়, ভেতর দিয়ে রোদ ঢুকতে পারত না। রাম বলল, ভাই, আমরা বনবাসে এসেছি, এখানে কষ্টে থাকতে হবে, আরাম করা চলবে না। কিন্তু এই গাছের ছায়ায় আমরা সুখে আছি, আমাদের গায়ে রোদ বৃষ্টি লাগছে না। এটা তো ঠিক নয়। তুমি তীর মেরে পাতাগুলোকে চিরে দাও।

লক্ষ্মণ তীর মেরে তেঁতুল পাতাগুলোকে চিরে ফালাফালা করে দিল। একটা পাতা চিরে অনেক ছোট ছোট পাতা হয়ে গেল। সেই পাতার মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জল আর রোদের তাপ তাদের দেহে লাগল। সেই দিন থেকেই তেঁতুল পাতা এত ছোট ছোট হয়ে গেল। আবার চলেছে তিন জন। বনপথ দিয়ে চলেছে। চারিদিকে বন্য বন্য সেই অরণ্য। এবার তারা ঘর তৈরি করল খেজুর গাছের নিচে। সেই কালে খেজুর পাতা ছিল খুব লম্বা আর চওড়া। বৃষ্টির জল আটকে দিত সেই পাতা। রাম আবার ভাইকে তীর ছুঁড়তে বলল। লক্ষ্মণ তীর মেরে খেজুর পাতাকে সরু সরু করে দিল। সেইদিন থেকে খেজুর পাতা সরু সরু হয়ে গেল।

গল্পটি তৈরি হয়েছে বিরহড় সমাজের মনোভূমিতে। গল্পটি বনবাসী সমাজে প্রচলিত অনেকানেক গল্পের মতোই, যা প্রমাণ করে রামায়ণের কাহিনী বনবাসী কৌমসমাজেরও উত্তরাধিকার। রামায়ণের শিকড় যে ভারতের আদিবাসী সমাজেও কতটা মজবুত তার প্রমাণ। ছড়িয়ে আছে বনবাসী কৌমগোষ্ঠীর পুরাণকথাতে।

আমার মা ‘ইতু লক্ষ্মীর ব্রত’ করেন। অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে শেষদিনে ব্রতকথা শোনান। তাতে আছে উমনো-ঝুমনোর গল্প। বাবা মেয়েদের বিবাহ স্থির করতে অসমর্থ্য হয়ে, সামাজিক লজ্জায় দুই মেয়েকে উমনো আর ঝুমনোকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে যায়। সন্ধ্যা হতেই সেখানে নামে ঘনান্ধকার। বনবাসী হিংস্র পশুর ডাক আসতে থাকে। রেহাই পেতে উমনো-ঝুমনো প্রাচীন তেঁতুল গাছের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। মস্ত তেঁতুল গাছ দু’ফাঁক হয়। তারই কোটোরে দুই হতভাগা মেয়ের রাত্রিযাপন হয়। খিদের জ্বালায় তাদের তেঁতুল ভক্ষণ।

যদিও ব্রতকথার নানান টেক্সট রয়েছে। তবুও পাবনার মেয়ে, আমার মায়ের এই গল্পে সেদিন তেঁতুলবৃক্ষ আশ্রয় আর আহার হয়ে ওঠায়, ছোটোবেলা থেকে এই গাছটির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না।

‘লাউ গড়গড়, লাউ গড়গড়/ খাই চিঁড়ে আর তেঁতুল/ বিচি ফেলি টুলটুল/ বুড়ি গেল ঢের দূর!” উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্পে কুঁজো বুড়ি পথ জুড়ে তেঁতুলের বীজ ছড়াতে ছড়াতে চলতে থাকে। বিগত শতকের শেষে জাপানি পরিবেশবিদ ম্যাসানুবু ফুকওকা-র মতোই মতাদর্শ বাংলার লোকায়তিক শিষ্ট কথাসাহিত্যে। জিরো টিলেজে বীজ বপন করো, প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল ফার্মিং।

এখানে মূল বক্তব্য, পথের ধারে তেঁতুলের গাছ লাগানোর টেক্সট। দক্ষিণ ভারতে তো এমন সংস্কৃতি আছেই। তামিলনাড়ু, পণ্ডিচেরী, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা প্রভৃতি রাজ্যে পথের ধারে সারি সারি তেঁতুলের গাছ। তেঁতুলের বাণিজ্য সেখানে খাদ্যাভ্যাসের কারণে এবং তা পরিবেশগত কারণেই।

আজও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া হয়– চলুন, গাড়ি ভরতি আম-জাম-কাঠালের তাজা বীজ নিয়ে বর্ষার শুরুতে দূরে কোথাও অরণ্যের মাঝে ফাঁকা আর্দ্র জায়গায় ফেলতে থাকি। বনের মধ্যেই বনসৃজনের গল্প এগুলো। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে যুগলপ্রসাদ চরিত্রটি বনের ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করে, অরণ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চায়। আমরাও যেন কেবল বন না কাটি। বরং বনে বন গড়ি। এমন মন গড়ি। আগামীদিনে পুরুলিয়া বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় পথিপার্শ্বস্থ উদ্ভিদ হিসাবে তেঁতুলের চারা লাগানো যেতে পারে।


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *