
[প্রস্তুত নিবন্ধটি রহড়া বালকাশ্রম সম্পর্কে প্রাক্তন ছাত্র ডক্টর কল্যাণ চক্রবর্তীর অনুভব ও উপলব্ধি। গত ২০১১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ উচ্চ ও কারিগরী বিভাগের পুরস্কার বিতরণী সভায় তাঁকে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানান। এটি প্রদত্ত অভিভাষণ অবলম্বনে লিখিত।]
মঞ্চে উপবিষ্ট বালকাশ্রমের কর্মসচিব পূজ্যপাদ স্বামী জয়ানন্দজী মহারাজ, উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তথা বালকাশ্রমের ছাত্রাধ্যক্ষ পূজ্যপাদ স্বামী অমেয়াত্মানন্দজী মহারাজ, দর্শকাসনে উপবিষ্ট বিশিষ্ট সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী শিক্ষক কর্মী ও আমার প্রিয় ছাত্রভাইরা।
আমার গর্ব, আমার অস্মিতা আমি রহড়া বালকাশ্রমের ছাত্র। আশ্রমে যে প্রাণের বিকাশ, প্রীতি, তার সামীপ্যে সান্নিধ্যে আমার অনেকগুলি বছর কেটেছে। যে ভক্তি, যে নিষ্ঠা দিয়ে আশ্রম তৈরি, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মী-সন্ন্যাসী মিলে যে সমগ্র সত্তা গঠিত, তার থেকে বিচ্ছেদ সম্ভব নয়, তার থেকে আমি বিচ্ছিন্নও নই। ভাগ্যচক্রে আমি পৃথিবীতে খানিক প্রশস্ত আসন পেয়েছি। আজ এখানে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যা বলতে পারছি তা সেই আসনের জোরে নয়, আশ্রম-মাতা আমার মা এই দৃঢ়তায়– এই প্রাণের ধর্মে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ আজ আমাকে যে সম্মান জানালেন তা আসলে আশ্রম মায়ের স্নেহের পরশ, তার পালিনী শক্তি।
মানুষের পরিচয় তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সে নিজেকে যথার্থভাবে প্রকাশ করে। প্রকাশ কি? না, নিজের সঙ্গে অন্যের সত্য সম্পর্ক। বালকাশ্রম এসে বুঝলাম, ভিক্ষা নয়, উপার্জন নয়, আত্মপ্রকাশেই আমাদের পূর্ণ অধিকার। সে অধিকার অর্জন করতে হবে। এখানে দেনাপাওনার সম্বন্ধ নেই। বিদ্যার্জন এখানে ব্যবসায়িক মাত্রা পায় নি। সেবার মধ্যে জীবনের মোক্ষলাভের যে সুযোগ, ত্যাগের মধ্যে জীবনের যে সার্থকতা– তার প্রাপ্তি অন্য কোথাও নেই।
বাইরে থেকে যাঁরা এখানে আসেন, তাঁরা আশ্রমের বিপুল সমগ্রতার রূপ খুঁজে পাবেন না। এখানে স্তরে স্তরে, পরতে পরতে যে প্রাণের পলি– এটাই এখানকার প্রকৃত ইতিহাস, এটাই এখানে সেরা সম্পদ।
আমি এই আশ্রমে ছিলাম। দিনরাত নানান বিচিত্র সুখদুঃখ ভোগ করেছি, চিন্তা করেছি এরপর কোথায়? কেবল বই পড়ি নি।আশ্রমের প্রকৃতি-পরিবেশ দেখেছি। লক্ষ্য করেছি উদ্ভিদ বনস্পতি, তার রকমারি বিচিত্রিতা। ঋতুতে ঋতুতে বনস্পতির বিকাশ, তাদের পুঞ্জিত অভ্যর্থনা, আনন্দ-রাগ। উৎসব-অনুষ্ঠানে-সঙ্গীতে-কর্মে আমার জীবন বিচিত্র হয়ে উঠেছিল। বাগানের পরিচর্যা করেছি, গাছের চারা তৈরি করেছি, জল দিয়েছি, ফুল তুলেছি। মন্দিরে কাজ করেছি, করেছি রান্নাঘরের কাজ।
বুঝেছি আশ্রমের পরিচালন ধারা, সেই সঙ্গে আমাদের যোগ, আমাদেরও অংশগ্রহণ। সেই বোধ থেকে বুঝতে চেয়েছি Dairy, Bakery, Tailoring, Printing, Agriculture, Dispensary, Sales Counter ইত্যাদির পরিচালন ব্যবস্থা। কী কী কাজ হচ্ছে, খাতাপত্রে কিভাবে হিসাব রাখা হচ্ছে, তার production unit, demand-supply system, প্রয়েজনীয় যন্ত্রপাতি, এমনকি তার সামান্য মেরামতি।
প্রথম যখন এলাম তখন চক্ষে ভরা তৃষা আর কণ্ঠে ভরা বাক। শিক্ষক-মহারাজরা শুধু এই বালকের অপাংক্তেয় ছেলেমি, অসংখ্য প্রশ্নের সঠিক ও সংহত জবাব দিয়ে জীবন-জিজ্ঞাসাকে গভীরতর করেন নি। সাগ্রহে শুনেছেন অদ্ভুত কল্পনা, বিচিত্র বক্তব্য। এখন বুঝি, অসংখ্য কাজের মধ্যে তাদের এই সময়টুকু একটি ছাত্রের জন্য দেওয়াটা কতটা কঠিন ছিল! আজ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
অসুখের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট্ট বালকটির মনের খুব কাছে এসেছেন তাঁরা। আশ্রমে ঠাঁই পেয়েছিলাম বলেই আজকে আমি ড. কল্যাণ চক্রবর্তী হতে পেরেছি। পেরেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে। নইলে হারিয়েই যেতাম। আশ্রমের কাছে আমি তাই অশেষ ঋণী।
সেই সময় আশ্রমে বেশ অর্থকষ্ট ছিল। কিন্তু আশ্রমিকদের তা বুঝতে দেওয়া হয় নি কখনও। Minimum requirement -এর অভাব তাঁরা রাখেন নি। আজ কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয়েছে। তোমরা অনেক ভাল আছো, অনেক সুযোগ পাচ্ছো, ভাল খাবার, পোষাক, বইপত্র, পড়ার পরিবেশ, শিক্ষক সবকিছু। এমন সুযোগ অনেক বাবা-মাই তাদের সন্তানকে দিতে পারেন না, তোমাদের একথা মনে রাখতে হবে।
গ্রামেগঞ্জে একসময় দেখেছি পরিবারের সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অর্ধাহারে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে হয়। পড়াশোনা তখন তাদের কাছে বিলাসিতা। তাই তোমরা যে সুযোগ পাচ্ছো তা অপচয় করলে অপরাধ হবে। কারণ এই সুবিধাটুকু আশ্রম কর্তৃপক্ষকে একরকম ভিক্ষে করে সংগ্রহ করতে হয়।
আশ্রম মা তাঁর সেবার প্রতিদান চান না। বস্তুগত আনুকূল্যে, আর্থিক সহায়তা আশা করেন না। কিন্তু চান না বলেই কি আমরা কেউ নিজেদের যথাসাধ্যে অর্ঘ্য সাজাবো না? আশ্রম থেকে বেরিয়ে, প্রতিষ্ঠা পেয়ে বলতে পারি না, “এই আমি পেরেছি মা, তুমি গ্রহণ করো”! যদি তা নাও পারি, আপন নিষ্ঠার দ্বারা, ভালবাসার দ্বারা আশ্রমকে গড়তে পারি, বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারি। সকলে মিলে পরস্পরের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে, অনুরাগে, সহযোগিতায় একাত্ম হওয়া যায়, যেটা আশ্রমের প্রাণধর্ম হবে। আশ্রমাত্মার সঙ্গে তোমাদের যতটুকু সত্য সম্বন্ধ হবে তার পুরোটা এখানে দান কোরো।
অতীতের প্রতিনিধি আমি, আমি প্রাক্তন ছাত্র। তোমরা বর্তমানের তরতাজা সবুজ প্রাণ, ভাবীকালের বীজ তোমাদের মধ্যে। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ কেবল চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক নয়, ভাল মানুষ, খাঁটি মানুষ হতে হবে।
“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।
এই যে বিপুল ঢেউ লেগেছে
তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,
সকল পরান দিক না নাড়া —
বাইরে দাঁড়া, বাইরে দাঁড়া। “
নিরাপদ সভ্যতা যদি গড়তে হয়, তবে বাইরের প্রাচুর্যের সঙ্গে অন্তরের ঐশ্বর্য যোগ করতে হবে। সংবাদপত্রে চোখ রাখলেই দেখতে পাই, দেশবিদেশের সভ্যতার কদর্য রূপ। সর্বত্রই সামাজিক অবক্ষয়। মানুষ যদি অসৎ হয়, স্বার্থপর হয়, নীতিহীন হয় তবে এই ঐশ্বর্য, এই অট্টালিকা, এই সভ্যতা টিকবে না।
তোমাদের মধ্যে যে পুঞ্জিত শুভশক্তি রয়েছে, যে অনন্ত সম্ভাবনা ঠাকুর তোমাদের দিয়েছেন তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। নিজের অন্তরে খোঁজ করো, নিজের অন্তঃপুরে খোঁজ করো। বাইরের ‘আমি’-র ভিতরে আর একটা ‘আমি’ থাকে। সেটা ‘বড় আমি’, সেটা ‘পাকা আমি’। দেখবে সেখানে রয়েছে পবিত্রতা, মৈত্রী, সৌহার্দ্য,জ্ঞান, ঐক্য, উদারতা। আশ্রম মায়ের ‘সোনার কাঠি — রূপার কাঠি’-র স্পর্শে তোমাদের সকলের এই মানবিক সম্পদ জেগে উঠুক। এজন্য লক্ষ্য স্থির করতে হবে৷ এজন্য নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সহনশীলতা চাই। এসব নিয়েই জীবনের কাজে এগোতে হয়।
ঠাকুর বলছেন, ‘আমায় ধরো। বাকি সব আমি করে দেবো।’ তোমরা দেবভূমিতে রয়েছো, এখানে স্বয়ং ঠাকুরের অধিষ্ঠান। তাঁর পরশে তোমাদের অসাধ্য কিছুই নেই। যা করবে তাতে যেন আদর্শ থাকে, আনন্দ থাকে, উৎকর্ষতা থাকে৷ এগুলির ক্রম বিবর্তনও যেন থাকে। যেমন স্থূল আনন্দ ছেড়ে সূক্ষ্ম আনন্দ, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সূক্ষ্মতর থেকে সূক্ষ্মতম আনন্দ। পঠন-পাঠন-গবেষণা-কর্মজীবন সব জায়গায় এটা চাই, ক্রম বিবর্তন, এগিয়ে যাওয়া, চরৈবতি। এই যে উন্নতি, এটাই ব্রহ্মলাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ব্রহ্মলাভ করাই আমাদের উদ্দেশ্য। বালকাশ্রমে থেকে এটাই আমাদের লাভ করতে হবে।
“আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।”
ভাল থেকো, সুস্থ থেকো, আনন্দে থেকো৷
জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ।