
‘গাব’ বলতেই রামকৃষ্ণ মিশনে গানের ক্লাসের কথা মনে পড়ে। মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, তবলায় চামড়ার গোল জমাটবাধা খয়েরি আঠালো শুকনো অংশ। তাতে গোটা দুই চাঁটি মেরেছি কখনও সখনও। কিন্তু বাদ্যযন্ত্র শেখা হয়নি। তবে জেনেছিলাম গাবের ঘন কষ দিয়ে তৈরি হয় এটি। তবলার মাস্টারমশাই ছিলেন রাধারমণ স্যার। আনাড়ি হাতে যেই তবলায় ঘা দিতাম, বলে উঠতেন, “গাব চটাস না।”
গাব দিয়ে প্রস্তুত ওই অংশে তবলায় মিঠি বোল ওঠে। তা উঠে গেলে মুস্কিল। গানের স্যার অমর বাবু কীর্তনীয়াদের বলতেন ‘গাবিয়ে’। কারণ গাবের আঠার ওই খয়েরি রঙে আঙুল তুলে তুলে বাজনায় বোল তুলতেন তাঁরা। তারপর থেকে মৃদঙ্গ দেখলেই আমার চোখ যেতো ওই খয়েরি আঠায়।
পাড়ার ঘুড়িবাজ দাদা-ভাইয়েরা সে সময় সুতোয় উন্নত মানের মাঞ্জা দিতে ব্যবহার করতেন গাবের কষ, সজনে আঠা আর নষ্ট টিউবলাইটের গুঁড়ো কাঁচ। খড়দা-পানিহাটির গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ‘উননা কালে’ (ঢাকাই শব্দ, ‘উননা’ মানে শুকনো সময় অর্থাৎ শীতকাল অথবা গ্রীষ্মকাল) বিকেলে গিয়ে দেখি উল্টোনো নৌকো। তাতে গাবের আঠা মাখিয়ে শুকাতো দেওয়া হয়েছে।
অনেক পরে পার্কসার্কাস স্টেশনে একদিন দেখলাম ক্যানিং ফেরত ট্রেনের ভেণ্ডার-বগি থেকে নামছে ইঁট-রাঙা ঝুড়ি ঝুড়ি লাড্ডু ফল। নামাচ্ছে একদল ভাণ্ডারী। তাদের জিজ্ঞেস করলে, জানলাম গাবের ফল এগুলো, চামড়া ট্যানিং করতে কাজে লাগে। পার্কসার্কাসের কাছাকাছি অনেক ফ্যাক্টারি আছে।
কিন্তু যেদিন রমণীয় বসন্তের বিকেলে কর্ণমাধবপুর গ্রামে কচি তামাটে পাতার বৃহৎ বৃক্ষে পড়ন্ত সূর্যের আভা সমুজ্জ্বল হতে লাগলো, সেদিন মনে হল, এ ফল আমায় খেতেই হবে। দুধওয়ালা দীপেন দা-র বাড়িতে ছিল এক পেল্লাই গাবগাছ। বললে শ্রাবণমাসে গাব পাকে। পাকলে মখমলের মতো সেই ফল এনে দেবে আমায়। তার আগে অবশ্য সে গ্রীষ্মের শেষেই জামাইবাবু সংগ্রহ করে দিলেন কয়েকটি গাবফল।
ওটা ছিল বিলাতি গাব। খেতে ভালোই লেগেছিল। আমার মতো যে বালক খাদ্যযোগ্য বুনো ফলের স্বাদ পেয়েছে, তার কাছে বিলাতি গাব অপূর্বই লাগবে। এর পর দেশী গাব খেয়েছি, তেমন ভালো নয়। আঁটি সর্বস্ব, খোসা ছাড়ালে দেখলাম আটটি বীজে ঠাসা অন্দর।
“আর গাব খাব না, গাবতলা দিয়ে যাব না।
গাব খাব না খাব কি, গাবের মতন আছে কি?”
এ এক কাকের গল্প! বলা যেতে পারে ‘প্রগল্প’। মানে প্রবাদ তৈরির পশ্চাতের কাহিনি। একবার গাব ঠুকরাতে গিয়ে এক কাওয়ার ঠোঁট আঠায় গেলো জড়িয়ে। তাতেই হল বিপত্তি। বিপদ বুঝে কাওয়া প্রতিজ্ঞা করলো, কখনও গাব ছুঁয়ে দেখবে না সে। কিন্তু গাবের আঠা যেই না ছেড়েছে, সে স্ব-মূর্তি ধারণ করলো। সেটাই এই প্রবাদের দ্বিতীয় উক্তি। অর্থাৎ বিপদ কাটতেই স্ব-মূর্তি ধারন করার সহজাত অভ্যাস।
ছোটোবেলায় আমরা ক্লাসে আর দুষ্টুমি করবো না, এই প্রতিজ্ঞা করে স্যারের কাছ থেকে ছাড়া পেতাম। পরে সুযোগ পেলেই ফের দুষ্টুমি করলে স্যার এই প্রবাদ বাক্যটি আমাদের বলতেন। গাব খেয়ে সমস্যায় পড়ে, তা বেমালুম ভুলে মেরে, ফের পাকা গাবের রঙে-গন্ধে মোহিত হয়ে গাব-সুখ্যাতিই এবং গাব ঠুকরানোর প্রচেষ্টাই হল প্রস্তুত প্রবাদের মূল প্রতিপাদ্য। সেই প্রথম ‘গাব’-এর নাম শুনলাম।
আজ গাবের গাছই বা কোথায়? আর গাব খাচ্ছেই বা কে? আমি যখন ছোটো, তখনও রহড়ায় তেমন চোখে পড়ে নি এই গাছ! রহড়া-খড়দায় তখন ক’টা গাবগাছ টিকে আছে। একবার বন্ধুরা স্থানীয়ভাবে গাব-সুমারি করেছিলাম। অমুক অমুক জায়গায় গাবের গাছ আছে। আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, তার ফলের মধ্যে নানান বৈচিত্র্য– ফলের রঙ, তার আকার, ভেতরে শাঁসের পরিমাণ, কচি পাতার রঙ ইত্যাদি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে হর্টিকালচার ফার্মে যে গাব গাছটি দেখলাম, তাতে প্রতি বছর তিন-চার হাজার ফল ধরে থাকত।
এই ফল ক্রমশঃ বিরল আর স্বল্পদৃশ্য হয়ে উঠছে। পুরনো গাবগাছ কাটা পড়লে আশেপাশে নতুন গাছ লাগানোর চেষ্টা নেই। গাবগাছের বৈচিত্র্য যে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, এমন চিন্তার মানুষ নেই। সব ফল যে খাদ্য অযোগ্য তা নয়। কিছু গাবের ফল বেশ ভালোই খেতে, তার শাঁসও পুরু। গাছ ভর্তি অসংখ্য ফল বিনা যত্নআত্তিতেই হয়ে থাকে। কোনো কোনো গাবের টাইপ সত্যিই সংরক্ষণ করার মতো। তার ফলের আকার, স্বাদ, গুণগত মান ও ফলন যথেষ্ট। চিরহরিৎ এই ঘনপাতার এই গাছ।
লোকে বলে নাকি ‘ভূতের বাড়ি’; এমনই ঘন ঝোপালো গাছ, তাতে বড় গাঢ় সবুজ পাতা ঠাসা। ‘গাবগাছের ভূত’ বলে যে কথাটি চালু হয়েছে তাতে ভূতের বাসার ধরনটি বুঝিয়ে দেয় আমাদের। ছোটোবেলায় জানতাম, তাল-খেজুরের ব্রহ্মদৈত্যি খুব বেশি পাতার ঘন আস্তরণ পছন্দ করে না। যেসব ভূতপ্রেত ঘনান্ধকার পছন্দ করে, তারা থাকে শেওড়া, গাব, চালতা আর তেঁতুলের ঘন পাতার অন্তরালে। তাই নাকি ওদিকে রাত হলে যেতে নেই। গাবের পাতাগুলি দেখতে অনেকটা গরু-মোষের জিভের মতো। তার কাণ্ড বেশ শক্তপোক্ত। গাঁ-ঘরে মজবুত ঘর তৈরি করতে কাজে লাগে এর কাঠ।
গাবের কষ বার করতে লাগে কাঁচা গাব। তা ঢেঁকিতে কুটিয়ে মাটির চাড়িতে ভিজিয়ে রাখা হয় কয়েকদিন ধরে৷ শীত/গ্রীষ্মের শুকনো সময়ে পুকুরের জলে ডোবানো থাকে নৌকো। তা তুলে আনা হয় ফাঁকা জায়গায় বা তুলসীমণ্ডবের উঠোনে।
গাবের কষে চটের টুকরো ডুবিয়ে ডুবিয়ে নৌকোয় মাখানো হয় আর শুকোনো হয়। শুকোলে আবার মাখানো হয়, আবার শুকোনো হয়। এইভাবে নৌকো উল্টেপাল্টে, উপুড় করে মাখানো হয় গাবের কষের পরত। গাবের কষ মাখানো হলে নৌকো নিয়ে রাখা হয় ঢালুপথে গাছের তলায়, নতুন জল সে পর্যন্ত উঠে এলে নৌকো ভাসবে সঙ্গে সঙ্গেই।
গাবের কষ দিয়ে কীভাবে শক্তপোক্ত হয় নৌকোর কাঠ, ছোটোমামার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে লিখেছেন রানী চন্দ (আমার মা’র বাপের বাড়ি, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৮৪, পুনর্মুদ্রণ শ্রাবণ, ১৩৯৩: পৃষ্ঠা ১০৬), “মামীরা বলেন, ‘হুঁ, নৌকো তো নয়, যেন অরক্ষণীয়া কন্যা ছোট্ রায়ের। হলুদ জলে স্নান করাচ্ছেন মেয়ের রূপ খোলাতে৷’
অদ্বৈত মল্লবর্মনের উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সেখানে তিতাস নদীর তীরে মালাদের বাস। সেই গ্রামে ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তকলি, সূতাকাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়েই মালাদের সংসার। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মুহূর্তকথা গল্পে লিখছেন, “তিনি তখন টোনসুতোয় গাবের কষ খাওয়াচ্ছেন। ঘাটের গাবগাছে সুতোর একমাথা গিঁট দিয়ে বাঁধা।” এভাবে গাবের বিবরণ মানেই গ্রামের অখণ্ড বাস্তবতা আমাদের নিমেষে জারিত করে ফেলে। আমরা গল্পের জগতে চিত্রকল্প অনুসরণ করে পৌঁছে যাই অন্দরে। গাব এমনই এক গ্রামীণ অন্দরমহলের গাছ।
দেশি গাব একটি এশিয়ার ফল, আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। দেশি গাবের (Indian persimmon, Malabar ebony, Black-and-white Ebony, Pale Moon Ebony) সংস্কৃত নাম তিন্দুকা, উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম ডায়োস্পাইরস মালবারিক । বিলাতি গাবও রয়েছে, এই গাবের উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম Diospyros discolor বা Diospyros blancoi. দু’টিই ইবেনেসিই (Ebenaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
দেশী গাবের খাদ্যযোগ্যতা কম হলেও, বিলাতি গাব বেশ ভালো খেতে, ভালো দেখতেও। আপেলের মতো বড়সড় এবং গোলাকার। ওজনে কখনও চার-পাঁচশ’ গ্রামও হয়ে যায়। খোসার ত্বক মখমলের মতো, রঙ গাঢ় লাল। খোসা ছাড়ালে দেখা যায় সাদা বা গোলাপী নরম শাঁস, আর তা থেকে বেরিয়ে আসে সুগন্ধ।
বিলাতি গাবের পুষ্টিমূল্য পর্যাপ্ত। ১০০ গ্রাম শাঁস থেকে ৫০৪ কিলোক্যালরি খাদ্য জোটে। থাকে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-এ, ফসফরাস, লোহা, থায়ামিন, ভিটামিন-সি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি। ডায়বেটিস রোগে গাবের উপকারিতা জানা গেছে, আমাশয় রোগে ব্যবহৃত হয় গাছের ছাল।
দেশি গাব দেখতেও গোল, তবে খেতে বেশ কষ্ট এবং হালকা মিষ্টি। কাঁচা ফলের রঙ সবুজ, পাকলে গা’ হলদে রঙের হয়ে যায়। ফলের শাঁসে আঠালো ভাব এবং চটচটে হওয়ার কারণে, পাখি খেলে ঠোঁট-বিড়ম্বনায় পড়ে। বাগানে খাবার ফল না থাকলে, ফলের অভাবে মালঞ্চের পাখিও গাব ঠোকরায়। দেশী গাব কাজে লাগে ভেষজ চিকিৎসায়, এর বাকল আর কচিফল ব্যবহার হয়।
গাব থেকে ট্যানিন জাতীয় আঠা বের হয়। এই আঠা মাছের জাল শক্তপোক্ত করার কাজে লাগে। পোক্ত হয় পশুর চামড়া। নৌকোয় কাঠগুলির খাঁজে খাঁজে পিন দিয়ে তুলো ঢুকিয়ে বুজে দেবার পর, ফাঁক বন্ধ করে দিয়ে গাবের কষ-জল মাখানো হয়। এতে দেশীয় নৌকো টেকসই হয়, জলে কাঠ বিনষ্ট হয় না। দেশি গাবের ব্যবহার মূলত এটাই। কাপড়-চোপড় ছোপাতে, কালো রঙ করতে গাবের ব্যবহার আছে।
গাবগাছ বেশ লম্বা হতে হয়, কখনো ৩৫-৪০ মিটার। কালচে রঙের গুঁড়ি, গুঁড়ির ব্যাস ৭৫ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে। বাংলায় গাব-সংস্কৃতির অনেক মূল্যবান সামগ্রী ছড়ানো রয়েছে। ছড়িয়ে রয়েছে মাঝিমাল্লার পল্লীতে পল্লীতে, নৌকো তৈরির গল্পতে, গাবের কষ-মাখানো মাটির পাত্রে। সেসব শুনতে গ্রামে এসো।
ছবি: লেখক।