গোয়া কি হাতের মোয়া? সৈকতের রাজ্য ঘুরে কলম ধরলেন পলাশ মুখোপাধ্যায়

Share with Friends

পলাশ মুখোপাধ্যায়।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই চমকে গেলাম (Gao assembly election)। সামনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) হাসিমুখের কিং সাইজ ফ্লেক্স। একটি নয়, তিনটি। তাহলে কি প্লেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার কলকাতাতেই নিয়ে এল? সংশয় কাটল পাশের লেখাটি দেখে, বড় বড় করে লেখা ‘গোয়েঞ্চি নভি সকাল’। গাড়ির চালক জানাল এটি কোঙ্কনি কথা যার মানে হল, গোয়ায় আসছে নতুন সকাল।

এয়ারপোর্ট চত্বর থেকে বেরিয়ে যত শহরের দিকে এগিয়েছি তত বেড়েছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হাসিমুখের ছবি। বাস স্টপ মুড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যানারে। রাস্তায় লাইটপোস্টে সার দিয়ে পোস্টার। মাঠে ঘাটে শহরে সৈকতে সর্বত্র তৃণমূলের পোস্টার ব্যানারে ছয়লাপ। বুঝলাম গোয়ার জন্য বেশ ভালমতই প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। ইতিমধ্যেই একটি নির্বাচনী জনসভায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন আর তিন মাস পরেই গোয়া তৃণমূলের দখলে আসছে।

আমাদের গাড়ির চালক মুকেশ বোডরেকর, গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার আপ্পিজি, কুল্লেম গ্রামের স্টেশনারি দোকানের মালিক প্রকাশ পারিকর, কোলভা বিচের হোটেল মালিক স্টিফেন সিলভেরিয়া অথবা বেনালিয়াম গ্রামের লোনা ইয়েভাট্টি ফার্নান্ডেজ। এরা একে অপরকে চেনেন না। কিন্তু একটা বিষয়ে সকলেরই মিল আছে, তা হল মাস খানেক আগে পর্যন্ত তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের নাম শোনেননি। কেউ কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনে থাকলেও তাঁর দল সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। গোয়া জুড়ে হঠাৎ তাই তৃণমূলের এমন পোস্টারে অবাক তারাও।

আমি বাংলা থেকে এসেছি শুনে সকলেরই একই প্রশ্ন তৃণমূল কেমন দল? বাংলায় তারা কেমন শাসন চালাচ্ছে? সর্বোপরি কতটা অসৎ সেই দলের নেতারা? গোয়া বহুদিন ধরেই কংগ্রেসের একটা বড় শক্তি। গোয়ার প্রবীন মানুষ বিনা প্রশ্নে এতদিন যাবৎ কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে এসেছেন। ২০০০ সালে সেই ধারাবাহিকতাকে সরিয়েই ক্ষমতায় আসে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হন মনোহর পারিকর। ২০০৫-এ ফের ক্ষমতা দখল করে কংগ্রেস, কিন্তু ২০১২ সালে আবার মনোহর পারিকরের নেতৃত্বে গোয়ায় বিজেপি সরকার গড়ে। সেই থেকে বিজেপিই আছে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির প্রমোদ সাওন্ত।

গোয়ার অবস্থাও অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মত। খারাপ, বেশি খারাপ এবং অতি খারাপ, বিকল্প বলতে এমনই। স্থানীয় প্রবীনদের মতে কংগ্রেস গোয়া থেকে শুধু ক্ষীর খেয়েছে, উন্নয়নে নজর দেয়নি। নবীনরা দ্বিধাবিভক্ত, কেউ কেউ বিজেপি আমলে হওয়া রাস্তাঘাটের আমূল সংস্কার, বিভিন্ন উড়ালপুল নির্মান ইত্যাদিকে উন্নয়ন মেনে পদ্মের পক্ষে। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রে বিজেপির নানা ভ্রান্ত নীতি, স্থানীয় নেতৃত্বের দুর্নীতি ইত্যাদিতে বেশ বিরক্ত।

কংগ্রেসের বেশ কিছু পোস্টার ব্যানার চোখে পড়ল বটে, কিন্তু সারা দেশে কংগ্রেসের যা হাল গোয়াতেও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। গোয়ার সাধারণ মানুষের কাছে বিজেপির বিকল্প হিসেবে কংগ্রেসকে বাদ দিলে ছিল আম আদমি পার্টি। আপ গোয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই করে চলেছে, তাদেরও কিছু পোস্টার ব্যানার নজরে এসেছে, কিন্তু তারাই যে বিজেপির সঠিক বিকল্প, সেটা এখনও গোয়ার সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারেননি।

সম্প্রতি গোয়ার প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক গোয়ায় বিজেপি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে মুখ খুলেছেন। তাই নিয়ে ব্যপক হইচই শুরু হয়েছে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে সব বিরোধীপক্ষই। এই ডামাডোলের বাজারে তাই তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই গোয়ার মানুষের মনে একটা কৌতূহল দানা বাঁধছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, অনাড়ম্বর জীবন যাপন নিয়েও তারা উৎসাহী।

এখানেই বেনিফিট অফ ডাউট পেতে পারত তৃণমূল, কিন্তু এত সহজে সেটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ গোয়ায় যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে তৃণমূল রাজ্য দখলের চেষ্টা করছে তাঁদের ভাবমূর্তিও খুব স্বচ্ছ নয়। গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা লুইজিন ফেরেইরো তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তিনিই তৃণমূলের গোয়া ফ্রাঞ্চাইজির এখন ক্যাপটেন।

লুইজিনের ভাবমুর্তিও কিন্তু স্বচ্ছ নয়, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর নামে বেশ কিছু অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি লুইজিন নিজেও অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস আমলে গোয়ায় উন্নয়ন কিছু হয়নি বরং দুর্নীতি হয়েছে। তিনি ছিলেন কংগ্রেস আমলে অন্যতম মুখ্যমন্ত্রী। তাই সেই আমলে হওয়া অনুন্নয়ন এবং দুর্নীতির দায় তিনিও এড়াতে পারেন না। গোয়ার মানুষ এখানেই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

তৃণমূলও এখানেই কিছুটা চাপে। পাশাপাশি গোয়া জুড়ে এত পোস্টার ব্যানার দেওয়ায়, এত টাকা কিভাবে একটি আঞ্চলিক দলের কাছে এল তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। গোয়ার বিভিন্ন ফেসবুক পেজ বা হোয়াটস গ্রুপে এই নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনাও। এর ফলে টিএমসি দলটা ঠিক কেমন হবে সেটা নিয়ে সকলেই একটু ধন্দে।

গোয়ার মানুষের মন জয় করবার জন্য তৃণমূলের হাতে খুব বেশি সময় নেই। গোয়ায় তারা এখনও নতুন দল। মাস তিনেকের মধ্যে গোটা রাজ্যের মানুষের আস্থা অর্জন করা একটা নতুন দলের পক্ষে বেশ কঠিন।

তবে লড়াই শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। রাস্তা ঘাটে তাদের নেত্রীর সহাস্য ছবির বিস্তার তার পরিচয়। পাশাপাশি ত্রিপুরার মত এখানেও একই ভুলের পথে বিজেপি। অকারণে তৃণমূলের পোস্টার ব্যানার ছিঁড়ে, মিছিল আটকে, প্রশাসনকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে তৃণমূলের পালে অতিরিক্ত হাওয়া বিজেপিই এনে দিয়েছে।

গোয়ায় তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি বাংলা থেকেও গিয়েছেন অভিজ্ঞ নেতারা। স্থানীয় মানুষজনও বাংলার এই দলটি সম্পর্কে জানছেন, নিজেদের মত করে খোঁজ খবর করছেন। এটা লড়াইয়ের একটা ইতিবাচক দিক। তবে এটা অস্বীকার করবার জায়গা নেই যে তৃণমূলের পক্ষে লড়াইটা বেশ কঠিন, খুব সহজে জয় আসবে না।

কংগ্রেসও বসে নেই, তারাও লুইজিন ফেরেইরোকে টার্গেট করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা বিজেপিও রাজ্য দখলে রাখতে বদ্ধ পরিকর। আপের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক এমনিতে ভাল হলেও এখানে ঠিক কি হবে তা এখনও পরিস্কার নয়।

সব মিলিয়ে জমজমাট গোয়ার লড়াই। তবে তৃণমূলের অতি আত্মবিশ্বাস কিছুটা সমস্যা আনতে পারে। সব দেখেশুনে আপাতত বলাই যায় তৃণমূলের জন্য অন্তত, গোয়া হাতের মোয়া নয়।


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *