ওরা পারে, আমরা না: পলাশ মুখোপাধ্যায়ের কলম

Share with Friends

পলাশ মুখোপাধ্যায়।

মাইশোর শহরটি খুব বিরাট নয় কিন্তু বেশ ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন, হাঁটতে ভালই লাগে। ভোরবেলা বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূরে দেখি একটা জটলা। প্রায় শখানেক লোকের হইচই। কৌতূহলী মজাপিপাসু মধ্যবিত্ত মন নিয়ে এগোতেই স্পষ্ট হল ব্যাপারটা। সামনেই একটি সিনেমা হল, সঙ্গম। সেদিনই মুক্তি পাচ্ছে একটি কন্নড় ছবি, সকলেই চলচ্চিত্রপ্রেমী তাঁরা তাঁদের প্রিয় নায়ক নায়িকার পোস্টার ব্যানার ফুলের মালা দিয়ে সাজাতে ব্যস্ত। সেই পোস্টারও বিশাল। এই ভোরবেলাতেও বেশ ভাল লাগল।

পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, মাইশোরে আমি যেখানে ছিলাম তার এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে একটি দুটি নয়, ১০টি সিনেমাহল রয়েছে। যাদের মধ্যে আইনক্স বা পিভিআরের মত হাল আমলের মাল্টিপ্লেক্সও আছে। মাইশোর শহরে কমবেশি ২০ টি সিনেমা হল। অর্থাৎ মাল্টিপ্লেক্সের পাশাপাশি এখানে সমান উৎসাহ এবং ভালবাসা দিয়ে মানুষ সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলিকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন।

পরে কর্ণাটকের বিভিন্ন মফঃস্বল, গ্রাম দিয়ে যখন গিয়েছি, তখন দেখেছি সেখানে সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহলগুলি কেমন রমরমিয়ে চলছে। চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ উৎসাহ ভরে ভিড় জমিয়েছেন সেখানে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুদীপ, যশ, দর্শন বা সদ্যপ্রয়াত পুনিত রাজকুমারের মত কন্নড় তারকাদের পুস্পশোভিত বিশাল বিশাল কাটআউট। আবার বলছি শুধু শহরে নয়, এ ছবি প্রত্যন্ত গ্রামেও।

আমার যেমন ভাল লেগেছে তেমন খারাপও লেগেছে নিজেদের অবস্থার কথা ভেবে। চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে আমাদেরও সুনাম আছে। বহু বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তাঁদের কাজের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রকে দেশ তথা বিশ্ববরেণ্য করেছেন। কিন্তু আজ আমাদের অবস্থাটা মোটেই সুখকর নয়।

কলকাতা তো বটেই বাংলাজুড়েই একের পর এক বন্ধ হয়ে গিয়েছে সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহলগুলি। একসময়ে রমরমিয়ে চলা সিনেমাহলগুলিতে আজ কোথাও বাদুড়ের বাসা কোথাও বা ভেঙে শপিং মলের উজ্জ্বলতা। আমাদের বাবা মায়ের নস্টালজিয়া, আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতির অধিকাংশ সিনেমাহলই আজ ইতিহাস।

যেটা কর্ণাটক পেরেছে আমরা তা পারিনি। তারা মাল্টিপ্লেক্সগুলিকে যেমন স্বাগত জানিয়েছে ঠিক তেমনই তাদের ঐতিহ্যকেও সযত্নে লালন করে চলেছে। আমাদের ঠিক উল্টো দশা। শহরের পাশাপাশি মফঃস্বলগুলিতেও ক্রমশ গজিয়ে উঠেছে মাল্টিপ্লেক্স। একের পর এক বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেখানকার নামী সিনেমাহলগুলি। মানুষ তিরিশ টাকার টিকিট তিনশো টাকায় কিনে সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন। পাঁচ টাকার বাদাম ভাজার বদলে এখন একশো টাকার পপকর্ন খাচ্ছেন সিনেমা দেখার ফাঁকে। গ্রামগুলির অবস্থা আরও খারাপ, সেখানে সিনেমাহলগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কোনও মাল্টিপ্লেক্সও গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ সেখানকার মানুষের ছবি দেখার মাধ্যম এখন টিভি বা মোবাইল।

আমরাই পারিনি। একের পর এক সিনেমাহলগুলি যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমরা কেউই প্রতিবাদ করিনি, কারণ খুঁজিনি। চলচ্চিত্র যে সংস্কৃতির অঙ্গ সেটা এক শ্রেণির মধ্যবিত্ত সমাজ মানতেই চাননি। তাই প্রকাশ্যে সিনেমাহল বন্ধের প্রতিবাদ বা সহমর্মিতা প্রকাশ করতে দ্বিধায় অনেকেই। কিন্তু কর্ণাটকের মানুষ ভোরবেলাতেও তাঁদের ভালবাসার কারণে সিনেমাহলের সামনে ভিড় জমান।

আচ্ছা বলুন তো? আমাদের বাংলাতেও তো অনেক স্টার এসেছেন গিয়েছেন। মানুষ তাঁদের জন্য পাগল হয়েছে, তাঁদের ভালবেসেছেন। কিন্তু প্রিয় নায়ক বা নায়িকার মৃত্যুতে তাঁর ফ্যান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এমনটা বাংলায় কখনও শুনেছেন। কিন্তু ওরা পারে। সম্প্রতি পুনিত রাজকুমারের মৃত্যুতেও তাঁর ৫ জন ভক্ত মারা গিয়েছেন শোকে আত্মহত্যা করে বা হৃদরোগে। দক্ষিণী চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন উদাহরণ এর আগেও ভুরি ভুরি আছে।

সংস্কৃতিপ্রেমী বলে আমাদের বাঙালিদের খুব অহংকার। অন্যদের আমরা এ ব্যাপারে পাত্তা দিতেই চাই না। কিন্তু বুকে হাত রেখে বলুন তো দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আজ কোথায় পৌঁছে গিয়েছে। তাদের ছবির বাজেট, তাদের নির্মান কৌশল, তাদের অন্য ধরনের গল্প বলার ধরন, এ সবই আজ বিশ্বব্যাপী সমীহ আদায় করে নিয়েছে।

আমাদের কিছু ভাল ছবি হয় নিশ্চয়, পুরস্কারও কিছু মেলে। কিন্তু বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কি দক্ষিণের ধারে কাছে পৌঁছতে পেরেছে, কিছু নকল করা ছাড়া। দু একটি ব্যতিক্রমী ঘটনার উদাহরণে কেউ বিতর্ক করতেই পারেন কিন্তু সত্যিটা চাপা থাকে না। দক্ষিণে এখনও হিন্দি ছবি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আমি দিন পনেরো ঘুরে কর্ণাটকে একটা হলেও কোনও হিন্দি ছবি পাইনি। দক্ষিণের অন্যত্রও ছবিটা অনেকটাই এক।

হিন্দি বা হলিউডি ছবি রিলিজ করলেও তা সেখানকার ভাষাতে ডাব করে দেখানো হয়। কিন্তু আমাদের বাংলাতে সেই সমস্যা নেই। কারণ আমাদের মত উদার সংস্কৃতিপ্রেমী আর কে আছে? নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টিকে ছেড়ে অন্যকে জায়গা দিতে আমাদের জুড়ি নেই। আমাদের এখানে কেউ বলেন না, হিন্দি বা ইংরেজি ছবি এখানে বাংলায় ডাব করে চালাতে হবে। প্রেস্টিজ চলে যাবে যে।

আমাদের এখানে কেউ বলেন না, বেশির ভাগ হলে বাংলা ছবি চালাতে হবে। কারণ আমরা সিনেমাহলগুলিই তুলে দিয়েছি যে। মাল্টিপ্লেক্স চেইনগুলির মালিক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবাঙালি। তাদের তো মুনাফাই লক্ষ্য, আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবার দরকার তাঁদের নেই, কেউ কিছু বলেও না। কিন্তু দক্ষিণীরা সেটা করতে পেরেছেন, সেখানে ছবি মুক্তির সময় স্থানীয় ভাষায় ডাবিং এর জোর দেন মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষই।

আমরা কতটা সংস্কৃতিপ্রেমী তা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু আমরা যে ভাল দর্শক নই তা প্রমাণ করে দিয়েছি হলের সংখ্যা কমিয়ে। কারণ এক একটা সিনেমাহলে ৫০০ থেকে দেড় হাজার পর্যন্ত লোক ধরত। সেখানে একটা মাল্টিপ্লেক্সে ২৫০ থেকে ৩০০ লোক ধরে, খুব বেশি হলে ৫০০। অর্থাৎ বাংলায় সিনেমার দর্শক সংখ্যা কমে গিয়েছে উল্লেখজনক ভাবে।

আগে টিকিটের দাম কম ছিল তাই পারিবারিক ভাবে সিনেমা দেখার চল ছিল। এক সঙ্গে দশ পনেরো জন সিনেমা দেখতে যেতেন। এখন টিকিটের দাম১০ থেকে ১৫ গুণ বেড়ে গিয়েছে, তাই এক পরিবারে ২ জন সিনেমা দেখতে গেলেও চিন্তা করেন ৫ বার। গোটা বাংলা জুড়ে কয়েকটা সিনেমাহল শিবরাত্রির সলতের মত বেঁচে আছে। ধুঁকছে তারাও।

আমরা কি পারি না, ওই সিনেমাহলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে? আমাদের সকলের সামান্য একটু মনোযোগই কিন্তু এই হলগুলির ক্ষেত্রে সঞ্জীবনীর কাজ করবে। দক্ষিণের মানুষগুলি যদি পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না, আমাদের নস্টালজিকে সযত্নে, সগর্বে লালন করতে… ?

ছবি: লেখক।


Share with Friends

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *